বিয়ে হয়ে
শ্বশুরবাড়ী এসে গৌরী ভারী মুস্কিলে পড়ল। শ্বশুরমশাই আর বর সুদেব অফিসে বেরিয়ে গেলে
ঘর একদম ফাঁকা। শাশুড়ীমা তো কবে থেকেই ছবি হয়ে ঝুলছেন দেওয়ালে। একা বাড়িতে তার সময়
আর কাটতে চায় না। তার উপরে আরেক জ্বালা বাথরুম বা স্নানঘর। গ্রামের মেয়ে গৌরী।
চিরটা কাল পুকুরে নাইতে যেত। এই মফস্বলের স্নানঘরে তার গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে।
স্নানের জল ছিটকে দেয়ালে লাগে, দেয়াল ফেরৎ তারা আবার গায়েই যে ফিরে আসে না – তারও তো কোন মানে নেই। সারাদিন ধরে এই অশুচিতা বয়ে বেড়াতে হয় তাকে।
স্নানের জল ছিটকে দেয়ালে লাগে, দেয়াল ফেরৎ তারা আবার গায়েই যে ফিরে আসে না – তারও তো কোন মানে নেই। সারাদিন ধরে এই অশুচিতা বয়ে বেড়াতে হয় তাকে।
এমনি এক একলা
দুপুরে আইডিয়াটা এসে গেল। বাড়ীর পিছনের চৌবাচ্চা-ওয়ালা উঠোনের পাঁচিলটা তো অনেক
উঁচু – তাই না? ব্যস, সমাধান তো
হয়েই গেল। বাড়ী ফাঁকা হলেই সে তেল- সাবান নিয়ে উঠোনে চলে আসে। আনন্দে তার গলায় গান
বেজে ওঠে গুনগুনিয়ে।
গোলটা বাঁধল দু –একদিন
পরে। স্নান করতে করতে গৌরীর চোখ পড়ল, পাঁচিলের ওপর বসে থাকা কাকটার ওপর। দ্রিঘাংচুর
স্টাইলে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকে দেখে যাচ্ছে একমনে। হুশ হাশ করার পরেও নড়ল না কাকটা। বেশ
গ্যাঁট হয়ে বসে থাকল। বাধ্য হয়ে একমগ জল ছিটিয়ে দিল গৌরী। ডানা ঝটপটিয়ে উঠে
পাঁচিলের অন্য কোণে বসল দিব্বি। মুখ ভেংচে স্নান সেরে গৌরী ঘরে ঢুকে গেল।
পরদিন স্নানের
সময় কাকটা এল আবার। বসে থাকল স্নানের পুরো সময়টা। স্নান সারা হতেই উড়ে চলে
গেল।এমনি রোজ। প্রথমে হাসি পেলেও ধীরে ধীরে একটা অসোয়াস্তি ঘিরে ধরে গৌরীকে। খেয়াল
করে দেখেছে গৌরী, তার স্নানের সময় ছাড়া অন্য কোন সময় কাকটা আসে না। কাকটার ডানায়
একটা সাদা দাগ আছে বলে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না ওর। স্নানের সময় বদলে দেখেছে গৌরী –
ফলম্ যথাপূর্বম্। এবার ধীরে ধীরে অসোয়াস্তিটা ভয়ের দিকে এগোয়। সুদেবকে এক আধবার
বলতে গেছে, সে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে, বলেছে , “ওসব তোমার মনের ভুল।“ গৌরী সিদ্ধান্ত নেয় –
ঢের হয়েছে, কাকের চেয়ে বাথরুম ভাল।
পরদিন। শাওয়ারের
তলায় অনেকদিন বাদে আরামে চোখ বুজে স্নান উপভোগ করছিল গৌরী। চোখ খুলতেই দেখে
বাথরুমের জানালায় কাকটা বসে আছে। ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে বেরিয়ে আসে ও। খাটের উপর বসে
হাঁপাতে থাকে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে জানালায় যদি একটা কাক বসেই থাকে, তাতে ক্ষতি
কি ?
কিন্তু জানালায়
--- হঠাৎ বিদ্দুচ্চমকের মত গৌরীর মনে পড়ে গেল, বাথরুমে তো কোন জানালা নেই ! জ্ঞান
হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।
রাতে সুদেবকে সব
কথা বলল গৌরী। বরাবরের মত এবারো হেসে উড়িয়ে দিল সুদেব – “শেষে একটা কাক ! তা দেখুক
গে না। কাকের দেখা তো আর তুমি আটকাতে পারবে না ! তোমার ওই কল্পনার জগৎ ছেড়ে বেড়িয়ে
এসো বরং - ”
একটা হিমশীতল
অনুভূতি ছড়িয়ে পডল গৌরীর মেরুদণ্ড বেয়ে। পেটটা কেমন যেন মুচড়ে উঠল হঠাৎ। “আমার
দেখা তো তুমি আর আটকাতে পারবে না ?”- বলেছিল না অনেকদিন আগে অন্য একজন, অন্য এক
জায়গায়? শিউরে উঠে ঘুমন্ত সুদেবের আরো কাছ ঘেঁষে সে শুয়ে পড়ল একটু উষ্ণতার জন্য।
সেই অন্য একজনের নাম চন্দন। গ্রামের যেখানেই যেত গৌরী, সেখানেই হাজির হত
চন্দন। হাঁ করে শুধু দেখত তাকে। বিরক্তিতে মাথা ঝনঝন করত গৌরীর।
পড়াশোনা নেই, ইস্কুল কলেজের ধার মাড়ায় না, তেমনি বাচনভঙ্গী – মোদ্দা কথা চন্দনকে
দেখে ভাললাগার কোন কারণ খুঁজে পায় না গৌরী। একদিন ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ির
পর্যায়ে পৌঁছাল। চন্দন একটা প্রেমপত্র লিখে বসল গৌরীকে। বানান ভুলে ভরা
বিশ্রী হাতের লেখার সে চিঠি দেখে মাথায় আগুন জ্বলল মেয়ের। সটান গিয়ে হাজির হল
বাবার সামনে। হিসহিসিয়ে উঠল, - “গ্রামের মোড়লের মেয়েকেই যদি এভাবে কেউ অপমান আর
বিরক্ত করতে পারে, তাহলে অন্য মেয়েরা কেমন আছে বাবা, তোমাদের এলাকায় ?”
মোড়ল ডেকে
পাঠালেন চন্দনের বাবাকে, চিঠিটা দেখালেন। - “ছেলেকে অন্য কোথাও পাঠাও হে মিত্তির।
নয়ত আমি পঞ্চায়েত ডাকব।”
পঞ্চায়েত বসাতে
হয়নি। মিত্তিরমশাই চন্দনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দূরের গ্রামে তার এক বোনের বাড়িতে।
কিন্তু যাবার আগে চন্দন একফাঁকে গৌরীকে বলে গিয়েছিল – “আমাকে ভাগাতে পার, কিন্তু
আমার দেখাটা আটকাতে পারবে না !”
আজ সুদেবের কথায়
অনেকদিন আগে শোনা চন্দনের কথাগুলো কেন যে কানে বেজে উঠল !
পরদিন। সুদেব আর
শ্বশুরমশাই যথারীতি বেরিয়ে গেছেন। গৌরী এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কাঁপাকাঁপা
হাতে সে ডায়াল করতে থাকে বাড়ির নম্বর। চন্দনের বর্তমান খবর তাকে জানতেই হবে। রিং
হয়ে যাচ্ছে, - যাচ্ছেই। একবার, দুবার--- রিং হয়ে, হয়ে, কেটে গেল। হতাশায়, ক্ষোভে
দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার মনের মধ্যে কিসের টানাপোড়েন চলছে তা
বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আনত মুখটা তুলল যখন, তখন - আশ্চর্য ! ভয় নয় , অন্য এক
অনুভূতি ঘিরে আছে তার মুখখানা। হঠাৎ তার মনে হল, এত আয়োজন কি তাকে দেখার জন্যই?
কাকটা চন্দনই হোক আর যেই হোক শুধু তাকে দেখবে বলেই কি...। সে আর তার আয়না বাদ দিলে
তার সৌন্দর্য্য এত খুঁটিয়ে তো আর কেউ দেখতে চায় নি! তৃতীয়বার ডায়াল করল বটে, কিন্তু মাঝপথে রিংটা
এবার কেটে দিল গৌরীই। তার চোখের কোণে এখন
একটু দুষ্টুমি, একটু হাসি চিকচিক করছে। ঠোঁট টিপে কিছু একটা হিসেব করতে করতে হেসেও
ফেলল নিজের মনেই। এত কাণ্ড করছে কাকটা তাকে দেখবে বলেই! তাকে দেখার জন্য এত
আগ্রহ? অনেকদিন বাদে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে তেল সাবান নিয়ে চলল
উঠোনের চৌবাচ্চার দিকে। ঐ তো কাকটা এসেছে ঠিক। গৌরী মিটিমিটি হেসে ধীরে ধীরে শাড়ীটা
খুলতে শুরু করল।
এতদিনের এত
বিরক্তি, রাগ, ভয় যা করতে পারে নি, এই হাসি সেটাই করে দেখাল। গৌরীকে অবাক করে ডানা
ঝটপটিয়ে উড়ে পালিয়ে গেল কাকটা।
আর এই প্রথম,
কাকটা চলে যাবার জন্য গৌরীর মনটা খারাপ হয়ে গেল!
No comments:
Post a Comment