(১)
-
আমি
বিয়ে করছি।
-
কনগ্র্যাটস!
কিন্তু কাকে?
-
অরুণকে।
-
কেন?
-
কেন,
আবার কি? ওকে ভালোবাসি, তাই।
-
হুম।
কিন্তু অরুণও কি তোকে ভালোবাসে?
-
বোকার
মতো কথা বলিস না।ভালো না বাসলে বিয়ে করতে চাইবে কেন?
-
তার
অনেক কারণ থাকতে পারে। সেটা তুইও জানিস।
-
সবসময়
এত সন্দেহ করিস কেন?
শুধু ও অন্য দেশের লোক
বলে?
- সেইসঙ্গে মিহিকা নামের গরুটি প্রথম বিশ্বের
নাগরিক বলেও বটে।
- ভালো হচ্ছে না বলে দিচ্ছি বব। কোথায় সবার
আগে দৌড়ে তোকে জানাতে এলাম, আর তুই কিনা......
- বাড়িতে কি বলছে? তোর ভারতীয় কৃষ্টিতে তো
সেটাই সবচেয়ে বেশী জরুরি?
- মা বাবা দুজনেই খুব এক্সাইটেড।
- হুঁ, ভারতীয় ছেলে পাওয়া গেছে বলে কথা! তাহে
আবার বাঙালী! তোর তো কপাল খুলে গেল!
- এত ব্যাঁকাভাবে কথা বলছিস কেন?
- কিছুই বলছি না। শুধু বলছি, এত তাড়াহুড়ো করিস
না। আরো কিছুদিন দেখে নে।
- কিন্তু অরুণ খুব তাড়া দিচ্ছে জানিস? ওর আর
তর সইছে না।
- সেটাই তো সন্দেহের কারণ।
- বব, তুই কি কোনদিনও ভালোবাসা, রোম্যান্টিকতা
– এই ব্যাপারগুলো বুঝবি না?
- আমি ওটা ছাড়াও অনেক কিছু বুঝি। কিন্তু এসব
এখন তোর মাথায় ঢুকবে না। যাকগে, আমার কফি অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে। এবার আমি চলি। বিয়ের তারিখ ঠিক হলে জানাস।
কথা হচ্ছিল পাইক প্লেস মার্কেটের পুরোনো স্টারবাকসের
কফিশপে বসে। চারপাশের আধুনিক সব দোকানপাটের মধ্যে এই দোকানটা সেই দেড়শ বছর আগের
চেহারাটা ধরে রেখেছে। মিহিকার বাবা বলে ভিতরে ঢুকলে নাকি তার কলকাতার কফিহাউজের
কথা মনে পড়ে যায়। মিহিকার খুব অবাক লাগে। সেই কোন যুগে দেশ ছেড়ে সীয়াটেলে এসেছে বাবা – নাগরিকত্বও বদলে নিয়েছে সেই কবে! আর মিহিকা তো
জন্মসূত্রেই আমেরিকার নাগরিক। তবু কলকাতা বলতেই বাবা-মায়ের চোখে কেমন যেন স্বপ্ন
ভীড় করে আসে। দাদু-ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিন দু-তিন বছর পরপর কলকাতা যাওয়া
হত। মিহিকা তখন ছোট। অনেক লোক সেখানে, অনেক আদর। ভালই লাগত মিহিকার। দাদু মারা
যাবার পর কেন যেন যাওয়াটা কমে যাচ্ছিল। ঠাকুমা মারা যেতে একেবারে বন্ধই হয়ে গেল।
তবু কলকাতা, ভারত শব্দদুটোর এখনো কি এক মোহ – যেটা মিহিকা মজুমদারের মধ্যেও
সঞ্চারিত – বাঙালী শুনলেই কেন যেন একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়।
আর
বব কিছুতেই এই বিষয়টা বুঝতে পারে না। ছোট থেকে মিহিকার সাথে একসাথে বড় হওয়া
সত্ত্বেও নয়। তার বাবা আমেরিকান, মা মেক্সিকান। ভারত তার কাছে একটা ভিন্ন গ্রহ। আর বাংলার ব্যাপারটা তো
আরো গোলমেলে। দুটো আলাদা দেশের একই ভাষা। সে যাকগে,সে তো হতেই পারে। কিন্তু
ইন্ডিয়ান বাঙালীরা বলে বাংলাদেশটাও নাকি ওদের দেশ ছিল। অথচ বাংলাদেশীরা কখনো বলে
না ইন্ডিয়া ওদের দেশ। বব এগুলো জানে, কারণ ববের বাড়ি যে পাড়ায়, সেখানে প্রচুর
এশিয়ান থাকে। অত বিভাগ মনে রাখা সম্ভব নয় বলে একত্রে এশিয়ান বলাটাই রেওয়াজ। তাতে
বেশ ইন্ডিয়া পাকিস্তান বাংলাদেশ চীন কোরিয়া সবাইকে এক লপ্তে বোঝানো যায়। মিহিকাকে জিজ্ঞাসা করলে সে আবার দুশ বছরের
ইতিহাস বোঝাতে আসে! ধুত্তোর! একশ’ বছর আগে কি হয়েছিল তা নিয়ে ববের বিন্দুমাত্র
মাথাব্যথা নেই। বরং মিহিকার এই শিকড়প্রীতিটাই তার মাথাব্যথার কারণ। তাদের
সম্পর্কটা যে বন্ধুত্বের সীমানার চৌকাঠ পেরোতে পারে নি, সেটা মিহিকার এই বঙ্গপ্রেমের
কারণেই। মিহিকার মার মুখে বব শুনেছে যে সে দেশের
সংস্কৃতি নাকি এত ভালো যে ববের এই ঝকঝকে দেশটা তার কাছে নেহাতই গরীব।
তার
উপর জুটেছে ঐ অরুণ নামের ছেলেটা। খোদ ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাঙালী! মিহিকার বাবার মতোই
যে সেই সুন্দর দেশটা ছেড়ে এদেশে চাকরি করতে এসেছে! একটা ব্যঙ্গের হাসি ফোটে ববের
মুখে। এই বাঙালী হবার সুবাদেই অরুণ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই মজুমদার পরিবারের খুব কাছের মানুষ হয়ে
উঠেছে। অথচ শুধুমাত্র মিহিকার জন্য বাংলা শিখেও, বব যা হতে পারল না এতদিনেও। আর
মিহিকা? এদেশে জন্মেও বিয়ের ব্যাপারে সে নিজের চেয়ে মা-বাবার মতকে বেশি গুরুত্ব
দেয়। বব অন্য মেয়ের সাথে ডেটিংয়ে গেলে যে মেয়ে কোন না কোন অজুহাতে তিন চার দিন কথা
বন্ধ করে দিত, সেই আজ অরুণকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছে। একটা নিশ্বাস ফেলে
বাড়ির দিকে রওনা হয় বব। মিহিকা ওর বন্ধুই রয়ে গেল তাহলে!
(২)
মিহিকা
আর অরুণের বিয়েটা খুব ধুমধাম করেই হল। অরুণের ছুটি ছিল না বলে ওর বাবা মা উড়ে এলেন
আমেরিকায়। কিছুদিন থেকে আবার ফিরে গেলেন নিজেদের দেশে। ভারি খুশিতে থাকে দুজনে।
মিহিকাও একটা চাকরিতে যোগ দিয়েছে। একটাই আপশোস বিয়ের পরে অরুণ একবারও ইন্ডিয়ায়
নিয়ে গেল না ওকে। অরুণের ছুটি বড্ড কম।
এর
মধ্যে ববের সাথেও মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে বৈ কি মিহিকার। গল্প করেছে, হাসাহাসিও
করেছে বিয়ের আগে ববের সন্দেহ নিয়ে। ববও হাসে। বলে – তুই সুখে থাকলেই আমি খুসি। তোর
পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীতে আমিও একটা বিয়ে করে নেব ভাবছি। পার্টিটা কিন্তু তুইই থ্রো
করবি।
- কিন্তু পঞ্চমই কেন? কি এমন মহান ব্যাপার?
এটা
বললেই একটু গম্ভীর হয়ে যায় বব – সেকথা ছাড়। তুই খুশি থাক শুধু। আর আমার বিয়ের
রিসেপশনের পয়সা জমাতে থাক, বুঝলি?
বিয়ের
তিনবছরের মাথায় বদলির অর্ডারটা হাতে পেল অরুণ। তাও ধারে পাশে নয়। সেই সুদূর নর্থ
ক্যারোলাইনার শার্লোতে। প্রায় তিন হাজার মাইল
দূরে। ওর কোম্পানি একটা নতুন
ব্রাঞ্চ খুলেছে সেখান। মাইনেও বাড়বে অনেকখানি।
একটু মন খারাপ হলেও মেনে নিল মিহিকা। ঠিক করল, ওদিকে একটা চাকরি জোটাতে পারলে সেও
চলে যাবে অরুণের কাছে। ওখানে যাবার কয়েকমাস পরেই একটা লম্বা ছুটি পেল অরুণ।
মিহিকার চিরকালের শখ ইলিনয়ে বেড়াতে যাওয়া। ইলিনয় নর্থ ক্যারোলাইনারও মোটামুটি
কাছেই। তাই ঠিক করল দুজনেই উড়ান ধরে আলাদাভাবে ইলিনয়ের স্প্রিংফিল্ড এয়ারোর্টে
পৌঁছাবে। সেই রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অপরূপ ভাস্কর্যে চোখ মন সব ভরিয়ে
ফিরবে শার্লোতে। সেখানে কিছুদিন থেকে
মিহিকা ফিরে আসবে সীয়াটেলে। নিখুঁত পরিকল্পনা। মিহিকার বাবার শরীরটা কিছুদিন ধরে
ভালো যাচ্ছিল না। তাই একটু দোনামনা করছিল। কিন্তু চিরকালের মত বব এবারেও বলল – আমি
আছি। তুই নিশ্চিন্তে যা।
অরুণ
আর মিহিকা দুজনেই খুব উত্তেজিত। বাড়ি থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দুজনেই দুজনকে মেসেজ
করল। এবার আনন্দের পাখায় ভর করে উড়ে চলল মিহিকা। ঘণ্টা ছয়েক পরে স্প্রিংফিল্ড এয়ারপোর্টে
নেমে দেখল একঘণ্টা পরেই নামবে অরুণের প্লেন। কাজেই হোটেলে না গিয়ে এয়ারপোর্টেই
অপেক্ষা করতে থাকল। অরুণ অবশ্য ওকে বারবার বলে দিয়েছিল হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে
নিতে। মনে হতেই হাসি ভাঙল ঠোঁটের কোণে। সবসময়েই ওর স্বাচ্ছন্দ্যের খেয়াল রাখার
ব্যাপারে অরুণ অতুলনীয়। কিন্তু মিহিকা এয়ারপোর্টেই অপেক্ষা করবে। যদিও অরুণকে
বলেছে ও হোটেলে যাবে। অনেকদিন দেখেনি অরুণকে। ওকে এখানে দেখে কেমন চমকে যাবে সেটা
ভেবেই আবারও হাসি পেয়ে গেল।
অরুণের উড়ান মাটি ছুঁয়েছে। এক এক করে যাত্রীরা বেরিয়ে
আসছে। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে মিহিকা। কিন্তু কই অরুণ? এক এক করে সবাই বেরিয়ে
এলো। কিন্তু যার জন্যে এত অপেক্ষা, সেই অরুণ কোথায়? একরাশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে
দৌড়ে যায় এয়ারলাইনসের রিসেপশন ডেস্কে। তারা লিস্ট দেখে বলল, এই নামে টিকিট বুক
হয়েছে ঠিকই, তবে সেই যাত্রী এই প্লেনে চড়েনই নি। এদিকে অরুণের ফোন সমানে বলে
যাচ্ছে – সুইচড অফ। দুশ্চিন্তায় পাগল হবার দশা মিহিকার। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে
না। এয়ারপোর্টে এসেও অরুণ ফ্লাইট মিস করল কেন? তবে কি হঠাৎ শরীর খারাপ হয়েছে?
নানান এলোমেলো ভাবনা মন জুড়ে। অগত্যা পরদিনের নর্থ ক্যারোলিনায় যাবার টিকিট বুক
করে। আজ রাতটা অন্তত এখানেই অপেক্ষা করবে ও। এর মধ্যে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়ে যাবে
অরুণের সাথে।
(৩)
হোটেলে ঢুকতেই ববের ফোন। সব শুনে বলে – যা বাবা! ঠিক
আছে, তুই শার্লোতে চলে যা। আমিও আসছি। তবে অনেকটা দূর, একটু সময় তো লাগবেই। দেখ,
অরুণ হয়তো বাড়িতেই আছে কোন কারণে। আমায় ওর বাড়ির ঠিকানাটা পঠিয়ে দে।
আর বাড়িতেই থাকিস।
দুশ্চিন্তার রাতও একসময় শেষ হয়। আবার উড়ান। একসময় মিহিকা
পৌঁছেও যায় অরুণের অ্যাপার্টমেন্টে। চাবি খুলে ঘরে ঢোকে। ঘর গোছানোই আছে। একটু
স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে। অরুণ হয়ত কোথাও বেরিয়েছে। সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে
মিহিকা। হঠাৎ দরজায় বেলের আওয়াজে চমকে উঠল। ক্লান্তিতে দুশ্চিন্তায় সোফাতেই ঘুমিয়ে
পড়েছিল বেচারি! পড়িমরি করে দৌড়োল দরজা খুলতে। দরজার ওপারে অরুণ নয়, দাঁড়িয়ে আছে
বব! আর পারল না মেয়েটি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বসে পড়ল সিঁড়ির ওপরেই। পা দুটি আর ওর
ভার বইতে পারছে না। বব পাশে বসে। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টাও করে না। প্রিয়বান্ধবীকে
কাঁদতে দেয় প্রাণভরে। অনেকক্ষণ পরে শান্ত হয় মিহিকা। তখন দুজনে ভিতরে এসে বসে। বব
ব্যাগ থেকে খাবার বের করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়। মিহিকা এতক্ষণে বোঝে ওর খিদে পেয়েছে।
বস্তুত গত আঠেরো কুড়ি ঘণ্টায় ওর পেটে কিছু পড়ে নি। অল্প একটু খেয়েই হাত উঠিয়ে নিল –
আর পারছি না রে। বব জোর করল না। টেবিল পরিস্কার করে এসে বলে – এবার বল। প্রথম
থেকেই – কিছু বাদ না দিয়ে।
সব শুনে চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ে – কোথাও কিছু একটা
গোলমাল আছে। যেটা তুই, আমি বুঝতে পারছি না। পুলিসে রিপোর্ট করতে হবে। এক কাজ কর।
একটু ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর দেখ অরুণের কাগজপত্র কিছু খুঁজে পাস কিনা। তারপর চল
পুলিস স্টেশনে যাই।
মিহিকাও এতক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। স্নান করার পর
ক্লান্তিটা অনেকটা গেল। মাথাটাও একটু একটু করে কাজ করছে। প্রথমেই খুঁজল অরুণের
ডকুমেন্টস। পেল না কোথাও। ভাগ্যে অরুণের এস এস এন নম্বরটা ওর কাছে আছে!
পুলিস রিপোর্ট এল দুদিন পরে। অরুণ বাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে
ক্যাব ধরে এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিল। তারপর সে এয়ারপোর্টে ঢুকে যায়। তার কিছু পরে সে
বেরিয়েও আসে। সিসিটিভি চেক করে এটুকুই বলা যাচ্ছে যে সে একাই বেরিয়েছে
এবং স্বেচ্ছায়। একজন স্বাধীন মার্কিন নাগরিক তার ইচ্ছেমতো কোথাও যেতেই পারেন। কোনো
অপরাধ না ঘটালে পুলিসের এক্ষেত্রে কিছু করার নেই।
মার্কিন নাগরিক? হ্যাঁ, মিহিকার সাথে বিয়ের তিনবছর
পেরিয়ে যাবার পরে অরুণ এখন পুরোপুরি মার্কিন নাগরিক। এটা একদমই খেয়াল ছিল না
মিহিকাদের। কিন্তু অরুণ গেল কোথায়? ও যেন হাওয়ায় মিশে হারিয়ে গেল!
কলকাতাতেও খোঁজ করা হল। সেখানেও যায় নি অরুণ।
খবর পাওয়া গেল দুবছর পরে। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মুম্বাইয়ের
রাস্তায় আচমকাই অরুণকে দেখতে পায় সমর। সমর অরুণের সীয়াটেলের বন্ধু। কিন্তু কথা
বলার আগেই জনারণ্যে হারিয়ে ফেলে অরুণকে। তবে বুদ্ধি করে ওকে ডাকার আগে একটা ছবি
তুলেছিল মোবাইলে। সেটাই এনে মিহিকাকে দেখাল । কিচ্ছু বুঝতে পারে না মিহিকা। অরুণ
যেন ওকে একাটা বিশাল ‘কেন’ এর মুখে দাঁড় করিয়ে চলে গেছে। সেই উত্তরহীন প্রশ্নের
দেওয়ালে মাথা ঠুকে নিজেকে রক্তাক্ত করা ছাড়া আর যেন কোন কাজ নেই ওর।
বব দেখে মিহিকা ক্রমশঃ একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে। সে
না পেরে যোগাযোগ করে অরুণের সীয়াটেলের বন্ধু – সমর, রোহিত, অপালা, মধুরিমাদের
সাথে। তারা সকলেই অরুণের এই ব্যবহারে লজ্জিত এবং ক্ষুব্ধ। সবাই মিলে নিজের নিজের
বন্ধুদের দিয়ে খোঁজ করাতে শুরু করল। হোয়াটস অ্যাপ আর ফেসবুক মানুষের হাতে যে কত
ক্ষমতা দিয়েছে তা এইবার বোঝা গেল। কয়েক মাসের মধ্যেই সিমরন নামের একটি মেয়ের
প্রোফাইলে বিয়ের ছবিতে অরুণকে বরবেশে তার পাশে দেখা গেল!
তারপর বন্ধুর বন্ধু তস্য বন্ধুর চেন বানিয়ে যা উঠে এল,
তা নেহাতই সাধারণ বিষয়! নতুন কিছুই নয়। সিমরন অরুণের কলেজের জুনিয়ার। তার বিয়ে তার
বাবা “ফোরেন লড়কা” ছাড়া দিতে রাজি নন। মেয়েও এই ‘গন্ধা ইন্ডিয়া”য় থাকতে চায় না।
নেহাৎ অরুণ খুবই কাবিল লড়কা, চাকরিও পেয়েছে মার্কিন মুলুকে – আর সিমরনের পড়া শেষ
হতে এখনো কয়েক বছর দেরি – কাজেই প্রেমিকপ্রবরের হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। অরুণ
এদেশে এসে দেখল পয়সা দিলে আমেরিকায় নাগরিকত্বের জন্য অস্থায়ী বিয়ে করা যায়। সমস্যা
এটাই যে, এই সিন্ডিকেটের সাহায্য নিলে সারাজীবন ধরে প্রচুর পয়সা দিতে হয়। এই সময়েই
তার আলাপ হয় মজুমদার পরিবারের সঙ্গে। সে দেখল ভারতীয় এবং বাঙালী বলেই এখানে সে
সুপাত্র! একেই বোধহয় বলে ভাগ্যের পরিহাস!
সুযোগটা সে কাজে লাগাতে দেরি করে নি।
তিন বছরের
বিবাহিত জীবনটা তার দরকার ছিল নির্ঝঞ্ঝাট স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য। ছুটি কাটানোর
প্ল্যান করে সে অর্জন করে নিয়েছিল ফিরে যাবার জন্য কিছুটা প্রয়োজনীয় নির্ঝঞ্ঝাট
সময়। সে এখন মুম্বাইতে এক এম এন সিতে ডেপুটাশনে কাজ করছে। এরপর সে হয়ত, হয়ত কেন
নিশ্চয় ফিরে আসবে এই মহাদেশের অন্য কোন এক
কোণে।
(৪)
সিমরন আর অরুণের ছবি নিয়ে মিহিকা আর
বব আবারও স্টারবাকসে।
-
এভাবে চুপ করে থাকিস না মিহি,
কিছু বল।
-
আমার আর কিছু বলার নেই রে।
-
এই ছবিটা নিয়ে ঘোরা ছাড়া কিছু করারও কি নেই?
-
জানি না রে। সত্যি জানি না। এতদিন এক ভালোবাসাকে পাগলের
মতো খুঁজছিলাম। আর আজ------
-
এভাবে কাঁদিস না মিহি। তোর জীবন তোরই। কারো সাধ্য নেই
তাকে নষ্ট করে।
-
কি করব এখন?
-
কি করবি সে সিদ্ধান্ত তোকেই নিতে হবে মিহি। শুধু জেনে রাখ,
সব কাজে, সবসময় তোর সঙ্গে আছি। আমি তোকে কিছু রাস্তা দেখাতে পারি এই মাত্র।
-
রাস্তা? আছে?
এখনো?
-
রাস্তা কখনো বন্ধ
হয় না মিহি।
-
আবার জ্ঞান দিচ্ছিস?
-
আচ্ছা বাবা। এই নে। এক নম্বর – তোদের বিয়ের কাগজের জোরে
অরুণের এই বিয়েটা ভেঙে দিতে পারিস। সেক্ষেত্রে তোকে ইন্ডিয়ায় গিয়ে কেস লড়তে হবে।
-
এত পয়সা কোথায় পাব? কলকাতা হলেও না হয়...
-
সে ক্যালকুলেশনটা তোর আগে আরেকজন করেছে বলেই মুম্বাইয়ে
চাকরি করছে।
-
২ নম্বর?
-
তোর বিয়ের ছবি আর কাগজের জেরক্স সিমরনকে পাঠাতে পারিস।
বাকিটা ও করে নিতে পারবে।
-
এটাও ফ্লপ। অপালা ওকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল।
সিমরন ওকে ব্লক করে নিজের এফ বি অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিয়েছে। নিশ্চয় অরুণ কিছু
বুঝিয়েছে।
-
তিন নম্বর, অরুণকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের মতো করে জীবন শুরু
কর। একটা পোকা মারার চেয়ে সেটা জরুরি।
-
কিন্তু –
-
আমি রোম্যান্টিক নই, ভালোবাসাও বুঝি না। তবু চাইলে আমার
হাত ধরতে পারিস।
-
বব?
-
চেঁচাচ্ছিস কেন?
মিহিকা আসলে একটি গরুর নাম – তাই তুই বুঝতে পারিস নি।
-
বব, আমি –
-
চার নম্বরটা এবেলা না বললে অন্যায় হবে। আরো অনেক সময়
নিয়ে পরে পছন্দমতো কাউকে......
-
........................
-
এখানে বসে কাঁদিস না প্লীজ। লোকে আমায় মারবে। তার চেয়ে
চল বাইরে গিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরি।
-
মানে?
-
খানিকটা নেমে গেলেই তো লোনা জলের খাঁড়ি! এলিয়ট বের জল
আরেকটু লোনা করতে করতে না হয় সিদ্ধান্ত নিস।
দুজনে মিলে বেরিয়ে আসে সূর্য়ের
আলোয়। সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে মিহিকা। একটা সিদ্ধান্ত ওকে নিতেই হবে এবার।
No comments:
Post a Comment