বাদাবনের মানুষ, বাঘ,
কুমিরের সাথে মিলেমিশে দিব্বি ছিলেন সত্য – হঠাৎ বিভাগীয় বড়কর্তার ডাকে কলকাতা
ছুটতে হল তাঁকে। কি এমন ঘটল, যাতে নিম্নতম অফিসারের খোঁজ পড়ে, সেই জিগ্স পাজল
মেলাবার চেষ্টায় গলদ্ঘর্ম হতে হতে পৌঁছেও গেলেন একসময়।
আচমকা প্রশ্নে একটু থতমত খেলেও ঘাড় নাড়লেন সত্য। বিলক্ষণ
চেনেন। পাশাপাশি বীটে কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন। ডাকাবুকো লোক এই অতীন রায়।
সত্যপ্রিয়ের সাথে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে বিয়েও করেছে শুনেছিলেন
যেন।
- “নর্থবেঙ্গলের জলধারা বীটের নাম শুনেছেন ?”
আবারও মাথা নাড়লেন সত্যপ্রিয়। এবারেরটা নেতিবাচক। এবার একটা গল্প শোনালেন বড়কর্তা –
“জঙ্গলে ঘেরা ছোট নির্জন জায়গা। নতুন বীট অফিস খোলা হবে, তাই
বন কেটে বসতের দায়িত্ব পড়েছিল অতীন রায়ের উপর। দূরের গ্রাম থেকে মজুরেরা আসত। কাজ
শেষে ফিরে যেত নিজের ঘরে। অফিস ঘরটা বানান হয়ে গেছে ততদিনে। অতীন সেখানেই আস্তানা
গাড়লেন। একদিন সন্ধ্যের মুখে দুটি মজুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রবল জ্বর ও বমিতে
নাজেহাল। এই জঙ্গলে কোথায় ডাক্তার কোথায় কি ! অতীন বললেন আজ ওরা আমার এখানেই থাক,
কাল সকালে খাটিয়া এনে নিয়ে যাস।
অফিসঘরের নীচের তলায় মজুর দুটিকে শুইয়ে চলে গেল ওরা। জল আর
সঙ্গে যা ওষুধ ছিল তাই খাইয়ে অতীন ওপরের তলায় গেলেন। খাবারের যোগাড় করতে। খানিক
বাদে শুনলেন ‘বাবু জল’। নীচে নেমে জল খাইয়ে একটু সুস্থ করে আবার ওপরে গেলেন। এইরকম
চলল বেশ কয়েকবার। খানিক বাদে ওরা ঘুমিয়ে পড়ায়, তিনিও নিজের শোবার জোগাড়ে লাগলেন।
শোবার একটু পরেই তাঁর মনে হল, অনেকক্ষণ যেন সাড়া নেই। নীচে গিয়ে দেখেন শোবার
ভঙ্গীটা যেন কেমন কেমন। টর্চ জ্বেলে ভাল করে দেখলেন; নাড়ি, নিঃশ্বাস অনুভব করার
চেষ্টা করলেন। কঠিন সত্যটা প্রতিভাত হল এতক্ষণে।
এই নির্জন প্রায় আঁধার ঘরে সারারাত দুটি মৃতদেহের সাথে
কাটাতে ইচ্ছে হল না অতীনের। মনটাও বিকল হয়ে গেছে। বাইরে বেরোলেন। আশেপাশে অনেক
গর্ত খোঁড়া আছে, শব দুটিকে তারই একটাতে মাটি চাপা দিয়ে ঘরে ফিরে বসে রইলেন ভোরের
অপেক্ষায়।
সকাল হতেই মজুরেরা এল। সব শুনে তারা একটুও অবাক হল না। মাথা
নেড়ে বলল, কালকেই একথা তাদের মনে হয়েছিল। তারা মোটামুটি মৃতদেহ নেবার জন্য তৈরি
হয়েই এসেছে। সত্য চললেন ওদের সাথে মৃতদেহ হস্তান্তরের জন্য। মাটি সরিয়ে ফেলে চমকে
গেল সবাই। কই, দেহদুটি তো নেই ! কোন শেয়াল বা
অন্য কোন বন্যজন্তু নিয়ে গেলেও যে চিহ্ন থাকে তারও দেখা পাওয়া গেল না
কোথাও। পাগলের মত চারিদিক চষে ফেলল সবাই মিলে। কিন্তু বৃথাই। কোনই হদিশ পাওয়া গেল
না ! যেন লোকদুটো স্রেফ কর্পূরের মত হাওয়ায় উবে গেছে ! এবার এল পুলিশ। বিভাগীয়
অন্তর্তদন্তের ঝড় বয়ে গেল। অতীন কাউকে বিশ্বাস করাতে পারলেন না যে তিনি সত্যি কথাই
বলছেন। ধীরে ধীরে যেন নিজেকেই ঘটনাটা বিশ্বাস করান কঠিন হয়ে উঠল। ফল – নার্ভাস ব্রেকডাউন।
নতুন বীটবাবু এলেন, - অমিয় ব্যানার্জ্জী। কাজ শুরু হল আবার।
রাতে শুয়ে আধোঘুমে টের পেলেন, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কে যেন ধীরে ধীরে উঠে আসছে। পদশব্দ
এসে থামল দরজার কাছে, মৃদুস্বরে বাজল, ‘বাবু জল’। চমকে উঠলেন অমিয়,
দেখলেন ঘরের মেঝেতে শোয়া মজুরটি কাঠ হয়ে বসে আছে। অমিয় ভয়ে ভয়ে দরজা খুললেন –
বাইরে হা হা করছে জ্যোৎস্নার আলো, কেউ কোত্থাও নেই। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন
মাটিতে। সকাল হতেই বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বাড়ী।
এ ঘটনা ঘটেছে আরো কয়েকবার। বনবিভাগে জায়গাটা সম্বন্ধে আতঙ্ক
তৈরি হয়েছে। কেউ যেতে চাইছে না। মজুররাও রাতে থাকতে রাজি নয়। এর কিনারা না হলে
অফিসটাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। সত্যের সাহসিকতার অনেক গল্প শুনেছেন বলেই
জানতে চাইছেন, সত্য কী একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবেন ?”
শুনতে শুনতে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছিল সত্যপ্রিয়ের। অতীন রায়কে
তিনি জানেন। সৎ, সাহসী, খোলামনের এই সহকর্মীটির এই পরিণতি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন
না। বললেন,- “আমি যাব স্যার”।
- “ভাল করে ভেবে দেখুন সত্যপ্রিয়”।
- “ভেবেছি স্যার, ভেবেই বলছি”।
যথাসময়ে একদিন জলধারায় হাজির হলেন সত্যপ্রিয়। প্রথম দুটো
রাত কাটল নিরুপদ্রবে। তৃতীয় রাতে----
টুক,- টুক,- টুক – একটা পায়ের শব্দ না ? যেন মনে হচ্ছে একতলা
থেকেই উঠে আসছে। এগিয়ে এল শব্দ, দরজার কাছে এসে থামল। শুনতে পেলেন সত্য – ‘বাবু
জল’ !
সত্য তৈরিই ছিলেন মোটামুটি। এক ঝটকায় উঠে দরজাটা খুললেন। যা
আশা করেছিলেন তার কিছুই দেখতে পেলেন না। কেউ কোথাও নেই।
পরদিন। সারাদিন ধরে ভেবেছেন সত্য। শোবার আগে এক কলসী জল আর
দুটো গেলাস রাখলেন দরজার বাইরে। শূন্যকে লক্ষ্য করে বেশ উঁচু গলাতেই বলে উঠলেন, -
‘জল থাকল, যার ইচ্ছে জল গড়িয়ে খেয়ে নিও। আমাকে বিরক্ত করলে গুলি চলবে কিন্তু।’
আজ শোবার সময় লোডেড বন্দুকটা পাশে নিয়ে শুলেন। অপেক্ষা
রাতের। আওয়াজটা কি আজ হবে না? না, না ঐতো আসছে, - ধীর লয়ে – এইবার দরজার সামনে - ।
বন্দুকটা ঠিকভাবে বাগিয়ে ধরেন সত্য। কিন্তু কি আশ্চর্য, আজ তো জল চাইল না কেউ।
পদশব্দ ধীরে ধীরে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। বোধহয় হারিয়ে গেল জঙ্গলে। আর শুয়ে থাকতে
পারলেন না সত্যপ্রিয়, বন্দুকটা হাতে নিয়ে দৌড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। কেউ নেই
কোথাও। শুধু নদীটার পাশের ঝোপ থেকে একটা বিশাল রাতচরা পাখি আকাশে উড়ে গেল।
এরপর থেকে যতদিন ছিলেন সত্যপ্রিয়, জল আর গেলাস রেখে দিতেন
ঘরের বাইরে। রাতের অতিথিরা তাঁকে আর ডাকে নি কোনওদিন । দুবছর পরে আবার যখন বদলি
হলেন তিনি, - তখন বসত তৈরি হয়ে গেছে। জলধারা বীট অফিস তখন জমজমাট।
No comments:
Post a Comment