Tuesday, December 25, 2018

বন-জঙ্গল – ২ সত্যপর্ব - ২


সত্যপ্রিয়কে আজ আর চেনা যায় না। সুন্দরবনের দীনু নামের গ্রামবাসীটির মৃত্যু তাঁকে আমূল বদলে দিয়েছে। বাইশ বছরের অনভিজ্ঞ তরুণটি আজ বনবিভাগের অন্যতম দক্ষ ও সাহসী কর্মী।
বনকে ভালবেসে, তার অধিবাসীদের ভালবেসে সত্যপ্রিয় গত কয়েক বছরে অনেক কিছু শিখেছেন।
এখন বাঘের পায়ের ছাপ দেখে তিনি বলতে পারেন, বাঘটি পুরুষ না মেয়ে। বলতে পারেন কতক্ষণ আগে সে এ পথ দিয়ে চলে গেছে। চিনে গেছেন জঙ্গলের আওয়াজ পাতা পড়ার শব্দ, সাপ চলে যাবার সরসরানি কিংবা হরিণের ছুটে যাওয়া - আজ আর এক নয় তাঁর কাছে। জঙ্গলের নৈস্তব্ধ্যও যে সংকেত পাঠায়, তাও পড়তে পারেন আজকাল। নিজের ও পরের প্রাণ বাঁচাবার আকুল তাগিদে প্রাণ পণ করেই এসব শিখেছেন সত়্যপ্রিয় এই কয়েক বছরে।
বাঘের মুখোমুখিও হয়েছেন কয়েকবার।এই তো সেদিন –দুদিনের ট্যুরে যাচ্ছিলেন সত্যপ্রিয়, সুন্দরবনের প্রধান যান -নৌকায় চড়ে। ছোট ছোট ছিপনৌকো, যা থেকে এক ঝটকাতেই যাত্রী বা মাঝিকে তুলে নিতে পারে কুমীর, সরু খাল সাঁতরে সহজেই এসে পড়ে সুন্দর বনের মানুষখেকো। কিংবা মাথার উপর গাছের ডালে থাকতেই পারে সুন্দরবনের ভয়ঙ্করতম অধিবাসীটি – নাম শামুকখোল কেউটে। তা এসব ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলে না বাদাবনের মানুষদের। তাই সত্যও বসে থাকেন না।
দুপুরবেলায় খেয়ে নিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসেছিলেন সত্যপ্রিয়। জীবনমাঝি ছইয়ের ভিতর খেতে গেছে। নৌকোটা যেন একটু দুলে উঠল না ? দেখেন দক্ষিণরায়মশাই নৌকোয় ওঠার তাল করছেন। কপালের ফেরে হাতেও কিছু নেই। রাগে ভয়ে অনন্যোপায় সত্য প্রাণপণে এক বিকট হুঙ্কারে চারদিক কাঁপিয়ে তুললেন। বাঘটা ঠিক এটার জন্য তৈরী ছিল না। ঘাবড়ে গিয়েই হোক, বা আচমকা শব্দদূষণে বিরক্ত হয়েই হোক, নৌকো ছেড়ে উল্টো লাফে জঙ্গলে  অদৃশ্য হয়ে গেল।
চিৎকার শুনেই কাটারি হাতে বেরিয়ে এসেছিল জীবনওদের বলে দিতে হয় না কি ঘটেছে। এক নিমেষে চারপাশ জরিপ করে নিয়ে খুশী গলায় বলে, “বড় বাঁচা বাঁইচ্যা গেছেন কত্তা। আজকের দিনটি বড় ভাল।” হাল ধরে মনের খুশীতে গান ধরে জীবনআর সত্য ভাবে, জীবন না বেরোলে হয়তো আজ...
বড় পাকা মৌলি এই জীবন বনের ইশারা ইঙ্গিত বোঝায় তার জুড়ি মেলা ভার। বিচিত্র তার জীবন। নাঃ, একটু ভুল বলা হল বোধহয়। এদিকে সবার জীবনের গল্পটাই কমবেশী এরকম, জানেন সত্য।
জীবনের বাড়ীতে আছে ওর বৌ, দুই ছেলে আর আছে - না, ছিল – একটা মেয়ে। গত বর্ষায় নদী থেকে নেয়ে আসার সময় সে সাপের কামড়ে মারা যায়। ডাক্তারখানা অনেক দূর, সেখানে পৌঁছানোর আগেই----। বড় ছেলে বনে যায়, চাক ভেঙে মধু নিয়ে আসে। সাপ, কুমির, বাঘ পেরিয়ে যদি সে তিন কলসী মধু আনতে পারে তবে এক কলসী থানার বড়বাবু আর এক কলসী ফরেষ্টবাবুকে দিয়ে বাকি এক কলসী সে বেচতে পায়। এটা শুনে সত্য এই ছেলেটির পারমিট করিয়ে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি খুব ভাল করেই জানেন ও একা নয় আর এই পাপের ঘর ভাঙার ক্ষমতাও তাঁর নেই। তবু তাঁর প্রতি জীবনের কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। সত্য যখন যেখানে যান, জীবন  ছায়ার মত তাঁর সঙ্গে চলে। কারো কথা সে শোনে না।
ছোট ছেলেটি মাছ ধরে। নদীতে জাল ফেলে নয়। বলা ভাল মাছ চুরি করে। মানুষের থেকে নয়, বাঘের থেকে। বাঘ যখন মাছ শিকার করে, তখন মাছ ধরে নদীর পাড়ে জমা করতে করতে এগিয়ে যায়। যখন তার মনে হয় যথেষ্ট মাছ জমে  গেছে, তখন সে ফেরে ঐ পথ ধরে মাছ খেতে খেতে। জীবনের ছেলেটি তক্কে তক্কে থাকে। বাঘের পিছু পিছু গিয়ে সে সেই মাছগুলো থলেতে পুরে ফেলে। যেদিন একথা জেনেছিলেন সত্যপ্রিয় সেদিন বিষ্ময়ে আতঙ্কে মুখ দিয়ে শব্দ বের হয়নি তাঁর। জানতে চেয়েছিলেন, -“বাঘ টের পায় না ?”
-       “ হাওয়া বুঝে যেতে হয় গো কত্তা। হাওয়া যেন বাঘের দিক থেকে তোমার দিকপানে আসে। উল্টা হলি বাঘে তোমার গন্ধ পাবে গো। তাহলি....”
-       “তাহলে কেন এভাবে -?”
-       “জালের অনেক দাম গো কত্তা।”
-       “কিন্তু বা-বাঘটা কখন উল্টি ফিরবে বুঝবে কি করে ?”
-       “আনজাদ করতি হয় ছোটবাবু। মাছ ভরা শেষ হলি বন্ধুরে ইশারা করে। সেও তো এতক্ষণ আসছিল নদীতে নৌকা বেয়ে বেয়ে।এবার তীরে এসে মাছ আর মাছচোরকে নিয়ে হাওয়া।”
সদ্য প্রাণ ফিরে পাওয়া সত্যপ্রিয় এসবই ভাবছিলেন  তন্ময় হয়ে। জীবনের ডাকে চমক ফিরল।  
-       “জানো ছোটবাবু, আমাদের গ্রামের পাশ দে পাকা রাস্তা হতিছে। সব্বাই বলতিছে এবার আমাদের ভাল দিন আসবে। নগেনের বৌটা - জান তো তিনদিনের জ্বরে পট করি মরে গেল। রাস্তাটা হলি এবার আমরা ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে পারব বল ?”
সত্য জবাব দেননা। ওঁর মনে হয় এই দুঃসাধ্য জীবনযাপন যাদের মেরুদণ্ড বাঁকাতে পারে নি, তারা যেদিন তাদের সত্যি প্রাপ্যটা বুঝে নিতে শিখবে – সেদিন ? কি দেবে নগরসভ্যতা ? সোনাঝরা রোদের মত ঝলমলে দিন নাকি - - জানেননা সত্যপ্রিয়, শুধু এটুকু স্থির জানেন এই স্বপ্ন দেখা কখনো ফুরোবে না।

No comments: