“কলকাতায় জন্মকম্মো,
জঙ্গলে টিঁকতে পারবেন তো মশাই ?”
সময়টা ১৯৫৫ সালের কাছাকাছি। ফরেষ্ট বীট অফিসারের
চাকরির চিঠিটা পেয়ে যতটা খুশী হয়েছিল সত্যপ্রিয়, জয়েন করতে এসে ততটাই হকচকিয়ে গেছে
বেচারী।
জন্মাবধি শ্যামবাজার থেকে গড়িয়াহাট, আর তার বাইরে কখনো সখনো পিকনিকে ডায়মণ্ড হারবার; এ – তো - দূ - র অবধি তার গতিবিধি। কলকাতা থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণারও দক্ষিণপ্রান্তের এই প্রত্যন্ত মহকুমায় জয়েনিং রিপোর্ট জমা দিতে আসতেই সে তার জীবনের দীর্ঘতম যাত্রাপথটি অতিক্রম করেছে। আর চারপাশের দৃশ্যপট দেখে এখনি তার ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা ! নেহাৎই গরীব এই মহকুমাটিতে সে না দেখতে পেয়েছে কোন ভাল দোকান, না কোন ঝকঝকে জামাকাপড় পরা লোকজন। সিনেমায় দেখা বাংলো টাইপের ফরেষ্ট অফিসের জায়গায় তার সামনে এখন ম্যাড়মেড়ে হলুদরঙা একটা লম্বা বারান্দাযুক্ত বাড়ী – যার একটি ঘরে সে এখন বসে।
জন্মাবধি শ্যামবাজার থেকে গড়িয়াহাট, আর তার বাইরে কখনো সখনো পিকনিকে ডায়মণ্ড হারবার; এ – তো - দূ - র অবধি তার গতিবিধি। কলকাতা থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণারও দক্ষিণপ্রান্তের এই প্রত্যন্ত মহকুমায় জয়েনিং রিপোর্ট জমা দিতে আসতেই সে তার জীবনের দীর্ঘতম যাত্রাপথটি অতিক্রম করেছে। আর চারপাশের দৃশ্যপট দেখে এখনি তার ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা ! নেহাৎই গরীব এই মহকুমাটিতে সে না দেখতে পেয়েছে কোন ভাল দোকান, না কোন ঝকঝকে জামাকাপড় পরা লোকজন। সিনেমায় দেখা বাংলো টাইপের ফরেষ্ট অফিসের জায়গায় তার সামনে এখন ম্যাড়মেড়ে হলুদরঙা একটা লম্বা বারান্দাযুক্ত বাড়ী – যার একটি ঘরে সে এখন বসে।
টেবিলের
উল্টোদিকে বসে যিনি, তাঁর সংশয়াচ্ছন্ন মুখ দেখে আরো ঘাবড়ে গেল সত্যপ্রিয়।
প্রশ্নের উত্তরে মুখে প্রায় এসেই গিয়েছিল – “না স্যার আমি পারব না।” কিন্তু সেই
মুহূর্তে তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল বিধবা মা আর পড়ুয়া ছোট ভাইটার মুখ। সে
ফিরে গেলে ভাইয়ের পড়াটা –
জোর করে মুখে
একটা বেপরোয়া হাসি টেনে এনে নিজের সত্যপ্রিয় নামটার বিন্দুমাত্র মর্যাদা না রেখেই সে
জবাব দেয়,- “না টেঁকার কি আছে স্যার? আপনারাও তো আছেন।” বয়স্ক মানুষটির মুখে
এতক্ষণে হাসি দেখা দিল,-“আপনার কথা শুনে ভাল লাগল। স্পিরিটটা বজায় রাখবেন। পোস্টিং
যেখানে হয়েছে সেখানে এটাই আপনার ভরসা কিন্তু !”
জায়গাটার নাম
সত্যপ্রিয়র ভূগোল জ্ঞানের চৌহদ্দির বাইরে। সেই স্যারই হাল ধরলেন। “ওখান থেকে একজন গার্ড ডাক নিয়ে এসেছে আজ। কাল আপনি ওর সাথেই যাবেন অখন।“ বলেই হাঁক
পাড়লেন, -“রতন?” কালো দোহারা চেহারার লোকটি তাকে দেখে একগাল হাসল – “আপনে আমাদের
নতুন ছোটবাবু? চলেন আপনের থাকার ব্যবস্থা করি গিয়া। কাল সক্কাল সক্কাল তৈরি হয়ে
নিবেন, আমি আসব।”
রাতের ব্যবস্থা
বলতে একটা ছোট্ট হোটেল। তাতে সত্যর খুব একটা অসুবিধে হল না। এসব অসুবিধে বোধ
তার উড়ে গেছে সেই ছোটবেলাতেই – বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই। বাড়ীর কথা,
সারাদিনের কথা, নতুন জায়গার কথা – নানা ভাবনার মাঝেই ঘুম যে কখন দুচোখের পাতা জুড়ে
বসল, তা সে নিজেও জানে না।
সক্কালবেলার
যাত্রা শেষ হতে হতে বিকেল তিনটে। খড়বড়ে রাস্তায় নড়বড়ে বাস – যত না চলে, দাঁড়ায় তার
চেয়ে বেশী। মুরগীসহ লোকজন বাসের ভিতরে আর ছাগলসহ হলে ছাদে। আদিগন্ত মাঠ, বিল, ক্ষেত
– মাঝেমধ্যে গ্রাম। কখনো বিরক্তি, কখনো মজা, আর অনেকটাই অস্বস্তি নিয়ে সে
বিকেলবেলায় এসে পৌঁছাল চাকুরিস্থলে। নদীতীরে ছোটমতো ক্যাম্পাস, তাতে দুকামরার বীট
অফিসারের কোয়ার্টার আর দু চার ঘর গার্ডের বসবাস। শোনা গেল গ্রাম একটু দূরেই – হুঁ-ই মাঠের পারে বাঁশঝাড়ের পিছনে। নদীর ওপারে
ঘন ম্যানগ্রোভের জঙ্গল – সুন্দরবন ! রতন আশ্বাস দিল, “দিনের বেলায় দক্ষিণরায় এপারে
আসবে না,কাজেই এখন ভয় পাবার কিছু নেই।তবে রাতের বেলায় – তা বুঝলেন ছোটবাবু,
রাত-বিরেতে না বেরোনই ভাল!”
তা বুঝল বৈ কি
সত্যপ্রিয়। পরের রাতেই বুঝল। কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে পরদিন সকালে বিদায় নিলেন পুরোন
ছোটবাবু। সারাদিন ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটেই কেটে গেল। সন্ধ্যে সন্ধ্যে খাবার খেয়ে খাটের
ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে। পড়েই ঘুমিয়ে কাদা। কদিন খুব ধকল গেছে তো !
তা মাঝরাতে এক
অদ্ভুত গন্ধে ঘুম ভেঙে গেল তার। তাকিয়ে দেখে জানালা দিয়ে একজোড়া জ্বলন্ত হলুদ চোখ।
আতঙ্কে গা হিম, খাট থেকে নামতে পারছে না সত্য। কোনক্রমে খাটের উল্টোকোণায় জড়োসড়ো
হয়ে চেঁচাতে থাকে,-“রতন, ও র-ত-ন” - ! রতন
ঘর থেকে চেঁচায়, “বাবু, বন্দুক তো আপনার ঘরে। একটা ফাঁকা আওয়াজ করুন, চলে যাবে।”
আর বন্দুক ! খাট থেকে নামার অবস্থায় থাকলে তবে না........। এদিকে বাঘটাও মজা
পেয়ে গেছে। দাঁত খিঁচোয়, শিকের ফাঁক দিয়ে থাবা ঢুকিয়ে
সত্যকে ধরার চেষ্টা করে। খানিক বাদে বোধহয় সত্যের আচরণে বিরক্ত হয়েই বাঘটা চলেও
গেল! তখন সত্য দেখে – থাক সেসব কথা আর নাই বা বললাম! বাঘের বিরক্ত হবার যথেষ্ট
কারণ ছিল!
সব দুখনিশি
পোহায়। এ রাতটাও কেটে গেল পৃথিবীর দৈনিক আবর্তনছন্দে। সকালে চান করে এককাপ চা হাতে
নিয়ে এই জীবন, এই পৃথিবীটাকে বড় ভাল লাগল সত্যর। মনে ভেবে নিল, এরপর এখানে থাকা
তার পোষাবে না।
সপ্তাহের প্রথম
ডাকেই সত্য ঊর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে বদলির
আবেদন জানাল । জবাব এল, যতদিন পর্যন্ত না রিলিভার পাওয়া যাচ্ছে ততদিন তাকে
ওখানেই থাকতে হবে। নতুন এসেই এইসব বায়নাক্কায় চাকরির ভবিষ্যতও যে সরু সুতোয় তাও
বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রাঞ্জল ভাষায়। সত্যর প্রাণটা জলই হয়ে গেল বলতে গেলে। চাকরির মর্মান্তিক
প্রয়োজনটা না থাকলে ইস্তফা দিতে দুবার ভাবত না সে। কিন্তু, - হ্যাঁ এই কিন্তুটাই
বড় বাধা।
ভালয় মন্দয়
মিশিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল। ভোরের আকাশ যে এত সুন্দর হয় তা আর কবে দেখেছে সত্য,
রোদ্দুরে নদীর হীরের ঝলক দিয়ে নেচে ওঠাটাও তো জানা ছিল না তার। আবার রাতের
অন্ধকারের আতঙ্কটাও সমানভাবে সত্যি।
কিছুদিন বাদে খবর
এল, পাশের গ্রাম থেকে একজন লোককে বাঘে নিয়ে গেছে। আচমকা এই খবরে কাতর হয়েছিল সত্য
কিন্তু পাথর হল তখন, যখন শুনল, জঙ্গলের আইন বলে মানুষখেকো বাঘের শিকারকে ফেরত
আনতেই হবে। তাকে নিরুপদ্রবে মানুষ খেতে দেওয়া যাবে না কোন অবস্থাতেই।
রতন, বিজয়, অমিত –
সব বহুদিনের অভিজ্ঞ ফরেষ্ট গার্ড। তারা সত্যকে ভরসা দিল,”আমরা আছি স্যার। আপনি
শুধু আমাদের সঙ্গে যাবেন।” তাই গেল সত্য়। সঙ্গে গেল কিছু গ্রামবাসীও। রতনরা ভাল
লোক। তারা সত্যকে একটা গাছের উপর বসিয়ে দিয়ে বলে গেল, “বাঘ দেখতে পেলে ক্যু দেবেন
ছোটবাবু। আমরা মড়ি খুঁজতে চললাম।”
মৃতদেহের
অবশিষ্টাংশ ওরা বস্তাবন্দী করে নিয়ে এলে সত্য গাছ থেকে নামল। জানতে চাইল – “বাঘটা
কই?”
-
“তার মানে ?”
-
“আমি যে দেখলাম,
গ্রামের ওই মোটামত লোকটা – ওই যে দীনু – বাঘটাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ?”
মাথায় হাত দিয়ে
বসে পড়ল রতনেরা। মড়ি নিয়ে আসার আনন্দ ভেসে গেল চোখের জলে। হতভম্ব সত্য এতক্ষণে
বুঝল – বাঘ তার নতুন মড়ি পেয়ে গেছে। দীনুর গলার টুঁটিটা ধরে তার শরীরটা বাঘটা তার
চারপায়ের ফাঁকে রেখে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল! মুমূর্ষু দীনুর হাত পায়ের খিঁচুনীকে গাছের
ওপর থেকে সত্য ভেবেছিল অমিতাভ আর বাঘের লড়াইয়ের দৃশ্য!
*
*
সত্য সিদ্ধান্ত
নেয় – আর সে জঙ্গল ছেড়ে যাবে না। এখানেই বিজয়, অমিত রতনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে
লড়বে বাদাবনের মানুষগুলোকে বাঁচাবার জন্য। সে আর পালাবে না।
No comments:
Post a Comment