ইদানীং বাঁকুড়া – পুরুলিার ছোটনাগপুর
এলাকায় হাতীর উপদ্রব খুব সাধারণ ঘটনা। হাতীর সংখ্যা বেড়েছে, অথচ জঙ্গল না বেড়ে কমে
গেছে। ফলে হাতী খাবারের লোভে প্রায়ই চলে আসে লোকালয়ে। হরেন-বিপিন-আফজলের মাথার ঘাম
পায়ে ফেলে তৈরি ফসল খেয়ে ফেলে; মালতীবালার কলাবাগানের দফা রফা করে। এরা তাই মশাল,
ক্যানেস্তারা নিয়ে হৈ হৈ করে ওদের ভাগায়। কখনো এরা জেতে, কখনো ওরা। মাঝে মাঝে
গ্রামবাসীরা দল বেঁধে চড়াও হয় ফরেস্ট অফিসে। বিক্ষোভ দেখায়, তাতে কিছুটা ক্ষতিপূরণ
হয়ত পায়, কিনতু সমস্যাটার সমাধান হয় না।
বনবাবুদেরও করার বিশেষ কিছু নেই। বুনো হাতীর পালের সামনে তারাও বড় অসহায়। প্রতিবার হাতী নামার সময় হলেই বনবিভাগের তৎপরতা বাড়ে। তারা লোকজন, পটকা, মশাল, বাজনা সমাহারে হাতীদের রুট বদলে দেবার চেষ্টা করে। হাতীর দল নিজের রেঞ্জ ছেড়ে অন্য রেঞ্জে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আর ভাবে বদলির আর কত দেরি?
বনবাবুদেরও করার বিশেষ কিছু নেই। বুনো হাতীর পালের সামনে তারাও বড় অসহায়। প্রতিবার হাতী নামার সময় হলেই বনবিভাগের তৎপরতা বাড়ে। তারা লোকজন, পটকা, মশাল, বাজনা সমাহারে হাতীদের রুট বদলে দেবার চেষ্টা করে। হাতীর দল নিজের রেঞ্জ ছেড়ে অন্য রেঞ্জে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আর ভাবে বদলির আর কত দেরি?
অতীনও সেই হিসাবই কষছিল দুদিন দুরাত
হাতী তাড়িয়ে বাড়ী ফেরার পথে। হাতীখেদার দলের সাথেই ঘুরছিল এ দুদিন। আজ হাতীরা পাশের রেঞ্জে গেছে বলে তার
সাময়িক স্বস্তি। কোনক্রমে স্নান-খাওয়া সারতে না সারতেই ওর দুচোখ পেতে ঘুম নেমে এল।
কিন্তু আজকের শান্তির সময়টা বড় ছোট। কয়েকঘণ্টা পরেই তার ঘুম ভাঙল একটা হট্টগোলে।
গোলমালের সাথে কান্নার আওয়াজটা কানে আসতেই সতর্ক হল সে। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতা তাকে এক ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার
ইঙ্গিত দিচ্ছিল। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল অতীন, দুদিন আগে সুতপা টুকটুকিকে
নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে বলে। অনেক সময়ে বড় অপ্রীতিকর এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব
হয়। তাড়াতাড়ি একটা জামা গায়ে চড়িয়ে বাইরে আসতেই তার চোখে পড়ল বস্তাবন্দী
মাংসপিণ্ডটা।
যা বোঝার বুঝেছে অতীন। এবারের হাতীর দলটায় একটা হাতী ক্ষেপে
আছে। আগুন আর আওয়াজে অন্য সব হাতীরা দল পাল্টালেও এই হাতীটা মাঝে মাঝেই দলছুট হযে
তেড়ে আসছে। তখন কাউকে সামনে পেলে পিষে
মারছে পায়ের তলায়। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয় না ও, রাগের চোটে লক্ষ্যবস্তুকে মাংসের
তাল বানিয়ে ছাড়ে। এর আগে অন্য রেঞ্জের দুটি লোককে মেরে ফেলেছে হাতীটা।
বার বার সাবধান করেছে অতীন সমেত অন্য
বনকর্মীরা, যে হাতীর দলের থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। তবু ফসল রক্ষায়
মরিয়া লোকগুলো ঐ দূরত্বের অঙ্কটা মনে রাখতে পারে না। বড় বিষণ্ণ আর হতাশ বোধ করে অতীন। ক্ষেপে যাওয়া হাতীটার এটা তিন নম্বর
শিকার। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না কিছুতেই। আপাতত তার প্রথম কাজ লোকগুলিকে বুঝিয়ে
শান্ত করা। সে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেবার ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেয়। জমা হওয়া জনতাও
পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানে এই বড়বাবুটি যখন
বলেছে তখন উপায় একটা করবেই। অন্য কেউ থাকলে কি হত বলা যায় না, তবে এই বাবুটির
সততা, কর্মদক্ষতা এবং সর্বোপরি মানবতাবোধের পরিচয় আগেও বহুবার পেয়েছে তারা। তাই
দেরিতে হলেও তারা দেহপিণ্ডটি নিয়ে ফিরে যায়।
অতীন বসে রিপোর্ট লিখতে। জীবনে এই
প্রথম সে চেয়ে পাঠাল হাতিশিকারীর দল। তারা এসে ওই হাতীটিকে মেরে এলাকাকে মুক্ত
করবে এই উপদ্রবের হাত থেকে।
উপদ্রবই বটে! অতীন খুব ভাল করে চেনে এই
হাতীটিকে। হাতী না বলে হাতিনী বললেই বেশী ঠিক বলা হয়। অতীনের বাবাও ছিলেন ফরেস্ট
রেঞ্জার। জঙ্গলের নানা কাজের জন্য হাতী পোষা হয়। অতীন ছোট থেকে বড় হয়ে উঠেছে এই
হাতীদের সাথে সাথেই। তাই ও ওদের আলাদা ভাবে নিশ্চিত চিনে নিতে পারে। মানুষ রতিলাল,
সুবোধ বা অনিমেষকে যেভাবে চেনে ঠিক সেভাবেই চিনে নেয় হাতী গণেশ, রাজকুমার বা
জয়লক্ষ্মীকে। তার কাছে এই দুই প্রজাতির বিভেদরেখাটি বিশেষ স্পষ্ট নয়।
গতবছর যখন হাতীখেদা চলছিল, তখন এই
হাতীটা দল থেকে বারবার পিছিয়ে পড়ছিল ওর বাচ্চাটার জন্য। বাচ্চাটার পায়ে একটা চোট
ছিল, তাই তাড়াতাড়ি দৌড়াতে পারছিল না। হাতী তাড়াতে উন্মত্ত লোকজন মশাল ছুঁড়ছিল,
ক্যানেস্তারা বাজাচ্ছিল। কিছুটা ভয়েই বোধহয় মা হাতীটি কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল
বাচ্চাটিকে ফেলে। তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। কি যে হয়েছিল তা আজও ঠিকমত বোঝেনি
অতীন। শুধু দেখেছিল, বাচ্চাটার গায়ে একটা জ্বলন্ত মশাল এসে পড়তেই, ধ্বক করে আগুন
জ্বলে ওঠাটা। এরকমটা হবার কথা নয় – তাহলে কি মশালে অন্য কিছু ভরা ছিল? অন্ধকারের
ভীড়ে কে যে ওটা ছুঁড়েছিল, তাও সনাক্ত করতে পারা যায় নি। কিন্তু বাচ্চাটি ভীষণভাবে
জখম হয়েছিল। মা-ছেলের আর্তনাদে চারিদিক কেঁপে উঠেছিল।
অতীন খেদানো বন্ধ করে সবাইকে নিয়ে ফিরে
গিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু মশালের আলোয় সেই অসহায় মায়ের মুখটা তার মনে চিরকালের মত
খোদাই হয়ে গেল। হাতীর দল চলে যাবার কিছুদিন পরে জঙ্গলে বাচ্চাটির মৃতদেহ আবিষ্কার
হয়।
তার পর এই বছর। মা হাতীটি এই আগুন আর
আওয়াজ শুনলেই ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে আসছে। কাউকে ধরতে পারলে মাংসের ফুটবল বানিয়ে ছাড়ছে।
*
*
সরকারী লাল ফিতের ফাঁস ছাড়িয়ে
হাতিশিকারীরা যখন এসে পৌঁছাল তখন বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। গত কয়েকমাসে নতুন কোন
মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় নি। দলটার ট্র্যাক করাই ছিল। তারা আপাতত কাছের একটা জঙ্গলে
ডেরা বেঁধেছে। শিকারীদের সাথে অতীনসহ আরও দু-একজন রেঞ্জার আর কিছু গ্রামের লোক চলল
‘খুনী’ হাতীটিকে সনাক্ত করতে।
অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে শিকারীদলের
সাথে হাতীদের দলটাকে দেখে অতীন। কি আশ্চর্য! সে কিছুতেই চিহ্নিত করতে পারছে না
নির্দিষ্ট হাতীটিকে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে অতীন, না। ও চিনতে পারছে না! এত হাতীর
মধ্যে একটিকে সনাক্ত করা খুবই কঠিন কাজ। সঙ্গে বাকি যারা ছিল, তাদের একজন একটা
হাতী দেখায়, তো অন্যজন আরেকটা। খুব ভাল করে লক্ষ্য করেও কোন মত্ত হাতীর দেখা পেল
না শিকারীর দল। অগত্যা তারা ফিরে গেল। ফেরার পথে সহকর্মীর হাসিতে বিদ্রুপ – ‘সে কি
হে ওস্তাদ! তুমি ফেল মারলে?’ অতীন ম্লান হাসে, -‘এতগুলো হাতীর মধ্যে কেমন যেন
গুলিয়ে গেল।‘
রাতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অতীনের মাথায়
হাত বোলাতে বোলাতে সুতপা বলে, - ‘ছেড়ে দিলে?’ আর এতক্ষণে সুতপার কোলে মুখ গুঁজে হা
হা করে কেঁদে ওঠে অতীন, - ‘কিছুতেই পারলাম না সুতপা। ও আবার মা হতে চলেছে দেখলাম
যে!’
No comments:
Post a Comment