কথা হচ্ছিল
বিদায়ী ছোটবাবু রমেনের সঙ্গে চাকরিতে নতুন জয়েন করা অলকের। পশ্চিম মেদিনীপুরের
বেলপাহাড়ীর ফরেস্ট অফিসের বীটবাবুটির বদলির অর্ডার এসে গেছে। দু- চারদিনে তিনি
নতুন ছোকরাটিকে সব কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে নতুন পোস্টিংয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন। অলক
বনবিভাগের রীতি অনুযায়ী রমেনবাবুর ঘরেই আস্তানা গেড়েছে। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে
সেই বেলপাহাড়ীতে অন্য কোন ব্যবস্থা করাও সম্ভব ছিল না অবশ্য। একটা সরু রাস্তা
ঝাড়গ্রাম থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে কোনরকমে বেলপাহাড়ী এসে পৌঁছেছে। তার পিচ মাখানো গা শিলদার পর থেকেই
হাওয়া। লাল মোরাম বিছানো পথ দিয়ে সকালে একটা ঝরঝরে বাস এখান থেকে রওনা দেয়
ঝাড়গ্রামের দিকে। আবার সন্ধ্যাবেলায় ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরেও আসে। রাস্তার একদিকে
অনেকটা দূরে একটি আদিবাসী গ্রাম। আর অপর পারে বিশাল এক মোরামের প্রান্তর। তার
ওপারে হুইইই দেখা যায় একটা ছোট্ট পাকা বাড়ি। বীটবাবুর কোয়ার্টার কাম অফিস। তার
চেয়েও একটু দূরে এককামরার ছোট একটি ঘর। সবেধন নীলমণি ফরেস্ট-গার্ড বুধুর আস্তানা।
রমেনবাবু আশ্বস্ত করেন, - সারাদিন বুধু
সঙ্গ দেবে অলককে। তবে সন্ধ্যার পরে সে বাড়ি চলে যায়। পাশের গাঁয়েই তার বাড়ি কিনা!
তবে কিনা ওই রাতটুকুই। ভোরবেলাতেই হাজির হয়ে যাবে আবার।
যত শুনছে অলক, মনপ্রাণ ততই যাকে বলে
একেবারে “আনন্দে গদগদ” হয়ে উঠছে। খুশির চোটে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায় আর কি। নেহাৎ
ছোট থেকেই ডাকাবুকো বলে খ্যাতি আছে তার, নাহলে.....। রাত যে এমন নিকষ কালো হয়, এত
নিঃশব্দ - কলকাতার ছেলে অলক জানতই না কোনদিন। হারিকেনের মৃদু আলোয় চারপাশটা কিরকম
যেন অলৌকিক মনে হতে থাকে তার।
তবু, রমেনবাবুর কথাটায় যেন একটু
অতিরঞ্জনের আভাস পেল অলক। কুয়াশা মাখা রাস্তায় গাড়ি অ্যাকসিডেন্টের খবর সে পড়েছে
বটে খবরের কাগজের পাতায়, তাই বলে এটা একটু বাড়াবাড়ি ঠেকল তার কাছে। সেকথা বলতেই
রমেনবাবুর মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল – “জঙ্গল চিনতে তোমার এখনও অনেক দেরী
আছে হে। এককালে আমিও তোমার মতই ভাবতাম। আর তাই... ”
কথার শেষাংশ ওঁর সিগারেটের ধোঁয়ার মতই রিং পাকিয়ে পাকিয়ে আলগা হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
কথার শেষাংশ ওঁর সিগারেটের ধোঁয়ার মতই রিং পাকিয়ে পাকিয়ে আলগা হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
চনমনিয়ে উঠল অলক। একটা জমাটি গল্পের
সূচনা হতে যাচ্ছে। কিন্তু রমেনবাবু আর কিছু বললেন না। ঝিঁঝির ডাকে চারপাশের
অন্ধকার আর একটু চেপে বসে নৈশব্দকে আরও একটু ভারি করে তুলল। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল
অলকের, - “কি হয়েছিল দাদা?”
ফস করে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে অস্থির কয়েকটি টান দিলেন রমেন ---
ফস করে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে অস্থির কয়েকটি টান দিলেন রমেন ---
-
“ দার্জিলিং জেলার শামসিং-এ তখন রাস্তা
তৈরির কাজ চলছে। তখন এই
কাজের
বেশ কিছুটা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকেও দেখতে হত। ঘন জঙ্গলে ঘেরা সেই পাহাড়ে বেশ একটা
অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পেতাম, বুঝলে অলকভায়া। নতুন চাকরি তখন, রক্তও গরম ছিল। যে
বীটে আমার পোস্টিং ছিল, সেখানে জনা চার পাঁচ গার্ড মজুত ছিল। আর রাস্তার কাজের
জন্য একটা ছোট শ্রমিকের দলও ওই ক্যাম্পাসেই তাঁবু খাটিয়ে থাকত। সারা সকাল ভুতের মত
খাটতাম, আর সন্ধ্যাবেলায় ওদের সাথেই গোল হয়ে বসে ছাং খেতে খেতে নানান গল্প শুনতাম।
কত লৌকিক অলৌকিক গল্প যে শোনাত আমায় কুলিদের ওই বুড়ো সর্দার, তার ইয়ত্তা নেই। আমি
তার নাম দিয়েছিলাম মজবুড়ো। পাহাড়ী ভিজে ঠাণ্ডায় আগুনের ধারে বসে, অন্ধকার বনের
রাতের আওয়াজের সাথে মিলে সে গল্প আমার রক্তে রিমিঝিমি মাদলের বোল তুলত।
রাস্তার
কাজ খুব ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। এর মধ্যে একদিন সকালে রেঞ্জ অফিস থেকে ডাক নিয়ে সুখরাম পিওন এসে উপস্থিত হল। নতুন কিছু নয়।
প্রতি হপ্তায় সে রেঞ্জ অফিস থেকে ডাক মানে চিঠিপত্র নিয়ে আসে। আর পরদিন তার জবাব
নিয়ে যায়।
এখানে
এই ডাকব্যবস্থা সম্বন্ধে দু একটা কথা বলা দরকার। রাস্তাই নেই যখন, তখন গাড়িঘোড়ার
কথা ভাবাও বাতুলতা। রেঞ্জ অফিস থেকে সকালে পিওন বেরোত পিঠে চিঠির বোঝা নিয়ে। এক এক
দিন একেক দিকে। আমাদের দিকে আসার সময়,
মাঝখানে আরও অন্য কয়েকটা অফিসে ডাক দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ আমার বীটে পৌঁছে রাতের
বিশ্রাম নিত। পরদিন সকালে উত্তর নিয়ে আবার চলা। ফেরত যাবার সময় আগের অফিসগুলোতে
ঢুঁ মেরে জবাবী চিঠিগুলো নিয়ে যেত। এই তার কাজ।
আজ
সে সকালে পৌঁছেছে মানেই জরুরী কিছু। শুনলাম জবাব নিয়ে আজই তাকে ফিরে যেতে হবে।
অতএব তাকে খেয়ে নিতে বলে বসে গেলাম চিঠি পড়ে জবাব তৈরির কাজে। মন দিয়ে লিখছি এমন
সময় সামনে এসে দাঁড়াল মজবুড়ো। অফিসে সে এর আগে আসে নি কক্ষণো। একটু অবাক হয়েই
তাকালাম তার দিকে।একটু ইতস্ততঃ করে বলে কিনা, “আজ সুখরামকে পাঠিও না সাহেব। কাল
সকালে পাঠিও।“
বেশ
বিরক্ত হলাম। আমার কাজে দখলদারি করার এ কে?
– “কেন?”
– “কেন?”
বিরক্তিটা
বোধহয় টের পেল বুড়ো। তবু একগুঁয়ের মতো বলল,- “আজ সাদা দানোর দিন সাহেব।“
সাদা
দানো, মানে কুয়াশা? বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝকঝকে রোদ্দুর। তবু কী ছিল বুড়োর গলায়, ডেকে
পাঠালাম সুখরামকে। -“কুয়াশা হবে নাকি? যেতে পারবে?”
একগাল
হাসল নেপালী যুবকটি। -“চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও রেঞ্জ অফিস পৌঁছে যাব সাহেব। গত দশ
সাল ধরে এই কাজই তো করছি। আর আজ তো পরিস্কার দিন।”
মজবুড়োর
কথায় কেউই পাত্তা দিলাম না দেখে সে ভারি অপ্রসন্ন মুখে গজগজ করতে করতে নিজের
ছাউনিতে গিয়ে বসল। সুখরাম চিঠি নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। ঠিকভাবে চললে সন্ধ্যার আগেই
ওর অফিসে পৌঁছে যাবার কথা। আমিও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
বিকেল
গড়াবার আগেই নেমে এল কুয়াশা। প্রথমে হাল্কা, তারপর ঘন হয়ে। মজবুড়োর কথা মনে পড়ল।
তবে খেয়াল করে দেখলাম, কুয়াশা ঘন হলেও white out হয় নি। স্বস্তির
শ্বাস ফেলে ঘরে ফিরলাম। মজবুড়ো সেই যে তাঁবুতে গিয়ে সেঁধিয়েছে আর বের হয় নি। তার
মানে আজ আর গল্প শোনা হবে না। অগত্যা, আমিও তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সব স্বাভাবিক। বুড়োর কথা ভেবে একটু হাসিই পেল, আর একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন
অশিক্ষিত লোকের কথাকে অত পাত্তা দিয়েছি বলে নিজের উপর রাগও হল একটু। তারপর অবশ্য
সারাদিনের নানা কাজের ভীড়ে কিছু মনেও রইল না।
গোলটা বাঁধল পরদিন সকালে। রেঞ্জারবাবু নিজেই এসে হাজির হলেন আমার অফিসে। বেজায়
তম্বি, এত জরুরী একটা চিঠির জবাব না পাঠিয়ে আমি সুখরামকে এখানে বসিয়ে রেখেছি কেন?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে, সুখরাম সেদিনই রওনা হয়ে
গিয়েছিল। অবশেষে অফিসের আরও দু একজনকে ডেকে সাক্ষী প্রমাণ দিতে তিনি চেয়ারের উপর
ধপ করে বসে পড়লেন – সুখরাম অফিসে পৌঁছায় নি!
খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ..... এখান থেকে সরাসরি চোরবাটো বা সর্টকাট ধরে রেঞ্জ
অফিস যেতে পড়ে দুটি গ্রাম। তার পরে একটা পুল পেরিয়ে অফিস। তাদের মাঝে মাঝে বেশ
বিস্তৃত নির্জন জঙ্গল। সে সব জায়গায় খোঁজ
করে জানা গেল এক বিচিত্র তথ্য। প্রথম গ্রামের লোকজন বলল, তাদের গ্রাম পেরিয়ে যাবার
কিছু পরে সুখরাম আবার সেই গ্রামে ফিরে আসে। সে নাকি কি করে পথ হারিয়ে ফেলেছিল!
গাঁয়ের লোকেরা তাকে থেকে যেতে বলে, কিন্তু সঙ্গে জরুরী চিঠি আছে বলে সে রাজি হয়
নি। একটু বিশ্রাম করে চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় গ্রামে গিয়েও শোনা গেল একই ঘটনা। সে
নাকি সেতুটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না! গ্রামের একজন তাকে কিছুটা পথ এগিয়েও
দিয়েছিল। তারপর সে সেখান থেকে চলে যায়।
খোঁজ করতে করতে লোক পৌঁছাল আরও এক গ্রামে। সে গ্রাম তার চলার পথে পড়ে না
মোটেই।তবু শোনা গেল সুখরাম সেখানেও এসেছিল সেতুর খোঁজে। একটু বসে জলটল খেয়ে আবার
বেরিয়ে পড়েছে। গ্রামের একটি ছেলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে
প্রত্যাখ্যান করে। এত চেনা পথ তার! এপথ দিয়ে সে দশ বছর ধরে চলছে – তাকে নাকি আবার
পথ দেখাতে হবে? এভাবেই সেতুর চারপাশের অনেক গ্রাম থেকেই খবর আসতে লাগল। সুখরাম
এসেছে, বসেছে, আবার উদ্ভ্রান্তের মতো চলেও গেছে। ফরেস্টের লোকেরা তাকে অনেক খুঁজল –
কিন্তু এই বিশাল জঙ্গলে সে যেন কোথায় মিশে রইল। তার চলে যাবার খবর পাওয়া গেল,
কিন্তু তাকে দেখা গেল না। তিন চারদিন পর থেকে কোন গ্রাম থেকে তার খবর আসাও বন্ধ
হয়ে গেল। সেতুর কাছে পালা করে অনেকদিন অপেক্ষা করল লোকে। সুখরাম তার ব্যাগ নিয়ে,
ব্যাগভর্তি চিঠির বাণ্ডিল নিয়ে, হাতের লাঠিটা নিয়ে, জঙ্গলের ডালের সাথে, পাতার
সাথে, শিকড়ের সাথে, সেই পাহাড়ে কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। তার বাড়ির লোক
কত কাঁদল, গাঁয়ের লোক, সরকারের লোক মিলে কত খুঁজল – কিন্তু তার কোন চিহ্ন কোথাও
পাওয়া গেল না!”
রমেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, - “মজবুড়ো পরে বলেছিল, কুয়াশা যখন
মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন মানুষ দিক হারিয়ে ফেলে। তখন তার মধ্যে জন্ম নেয় এক
অবাধ্য রাগ আর জেদ কিংবা আতঙ্ক আর অসহায়তা। সাহস করে এক জায়গায় টিঁকে থাকতে পারলে
হয়ত বেঁচে যায় মানুষ; কিন্তু সাদা দানো তাকে স্থির থাকতে দেয় না। ছুটিয়ে মারে
একদিক থেকে অন্যদিকে। তারপর হয় মরে যায় কিংবা চিরতরে হারিয়ে যায় সেই অভাগাদের দল।”
রাতে যখন ঘুমোতে গেল অলক, তখন সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, এই গল্প একদিন
প্রাণ বাঁচিয়ে দেবে তার।
*
*
*
রমেনবাবু চলে গেছেন। সব কাজ বুঝে নিয়েছে অলক। সারাদিন তার অফিসের কাজে, নয়
জঙ্গল পরিদর্শনে কেটে যায়। কিন্তু সন্ধ্যাটা আর কাটতে চায় না। সে তাই বিকেল হলে
সেই মস্ত মোরামের মাঠ পেরিয়ে চলে যায় গ্রামেরই এক ভদ্রলোকের বাড়ি। সেখানে জমিয়ে
তাস খেলা হয়। গল্পে, তাসে সময়টা ভালই কেটে যায়। অলক বুধুকে বলে রেখেছে, বাড়ি যাবার
আগে সে যেন লন্ঠনটা জ্বালিয়ে বারান্দায় রেখে দেয়। খেলে ফেরার পথে রাতের অন্ধকারে
ধু-ধু তেপান্তর মার্কা মাঠটি পার হবার সময় ওটিই তার একমাত্র দিকচিহ্ন। সেই মোরামের
মাঠের শক্ত বুক চিরে কোন গাছ, এমনকি ঘাসেরাও গজিয়ে উঠতে পারে নি। উঁহু, ভুল বলা
হল, একটি হাড়গোড় বের করা অশ্বত্থ গাছ কি করে কে জানে, ঐ রুক্ষ্ম মাটি থেকে কোন
উপায়ে জীবনরস খুঁজে নিয়ে ডালপালা মেলেছে।
রক্তলাল সেই জমিতে গাছটিকে দেখলে চোখের আরামের চেয়ে অস্বস্তি হয় বেশি। গ্রামের
লোকেরা পারতপক্ষে গাছটিকে এড়িয়েই চলে। নানা উপকথা চলিত আছে ওর নামে। অলক অবশ্য এসব
কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। গাছটার পাশ দিয়ে গেলে রাস্তা কম হয় বলে এই পথেই তার
নিত্য যাতায়াত।
সেদিনও
তাস খেলার পরে রোজকার মতোই বাড়ি ফিরছিল অলক। মাঠে নেমে ঘরের হারিকেনের আলোর দিকে
চোখ গেল তার। একটু হেসে মাঠে নামল। আজ যেন একটু বেশি অন্ধকার। মনে পড়ল, আজ
অমাবস্যা। তারার হালকা আলোয় রাঙামাটির প্রান্তর কেমন যেন অদ্ভুত কালচে রং নিয়েছে।
বড় বড় পা ফেলে সে পৌঁছে গেল গাছটার তলায়। এইখানে এসে চারপাশটা কেমন যেন একটু অন্যরকম
ঠেকল আজ। বড্ড বেশি নিস্তব্ধ। ঝিঁঝিঁপোকা গুলোও চুপ করে গেছে। চারিদিক একটু বেশি
নিকষ কালো। আকাশ মেঘে ঢেকেছে – বুঝল সে। সামনে তাকাতে বেজায় চমকে গেল। হারিকেনটা
নিভে গেছে। বিরক্ত বোধ করল অলক। বাড়ি যাবার তাড়ায় বুধু তেল ভরতে ভুলে গেছে
নিশ্চয়ই। কাল ওকে বকুনি দিতে হবে। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাতের পাঁচশেলী
টর্চটা জ্বেলে সামনের দিকে পা বাড়ালো অলক। রোজকার চলা পথ। দিকের আন্দাজ তো আছেই।
বেশ খানিকক্ষণ চলার পর কিন্তু একটা অস্বস্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকল ক্রমশঃ। একটু
যেন বেশিক্ষণ চলা হয়ে গেল মনে হচ্ছে! অন্ধকারে কি সে বাড়ি পার হয়ে চলে গেল না কি?
এমন সব ভাবনার মাঝে সামনের একচিলতে গাঢ় অন্ধকার তাকে নিশ্চিন্ত করল। বাড়ির
কাছাকাছি এসে পড়েছে তাহলে! আর দু পা এগোতেই স্পষ্ট হল জিনিসটা। মাঠের সেই
অশ্বত্থগাছটা! কিভাবে যেন এক বৃত্তাকার পথে সে আবার ফিরে এসেছে তার সূচনাবিন্দুতে।
বিরক্ত
হল অলক।বেজায় রাগও হয়ে গেল তার। তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিন যে পথ দিয়ে সে যায়, আজ মাঠের
মধ্যে সেই পথে সে ঠিক করে চলতে পারল না! গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভাল করে দিক ঠিক করে
নিল সে। আবার চলা শুরু করল, আর ফিরে এল সেই গাছতলাতেই। আচ্ছা মুস্কিল হল তো!
সারারাত এই মাঠের মধ্যে তাকে ঘুরে ঘুরে আনি মানি জানিনা খেলতে হবে নাকি? আর ঘুরে
যাচ্ছেই বা কি করে? এই কোণা ধরে সোজা নাক বরাবর গেলেই তো.....। অলক খুব মনঃসংযোগ
করে একটুও দিকবদল না করে খুব ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। দেখা গেল, অন্যবারের চেয়ে আরও
তাড়াতাড়ি সে গাছের তলায় ফিরে এসেছে।
মেঘ
সরে গেছে। কিন্তু তারারা কেমন যেন আবছা হয়ে আছে। হেমন্তের রাতের হালকা কুয়াশায়
ঢেকে যাচ্ছে চারিপাশ। টর্চের ব্যাটারিও এতক্ষণ জ্বলে জ্বলে টিমটিমে হয়ে এসেছে।
এতক্ষণে সারা শরীর একটু কেঁপে উঠল অলকের। ইচ্ছে হল, এই অপয়া গাছটার থেকে অনেক দূরে
কোথাও চলে যায়। তবু একটু দম নেবার জন্য দাঁড়াল অলক। শরীর মন দুইই ক্লান্ত হয়ে
পড়েছে। তবু মনের কোণে কী যেন মনে পড়ে পড়ে, পড়ে না। অলক মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করল।
ভিতর থেকে কেউ তাকে যেন বলছে এই মনে করাটা খুব জরুরী। অথচ ওর সারা শরীর চাইছে
বাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে যেতে। শেষবারের মত ভাবার চেষ্টা করল অলক – কোথায় যেন
শুনেছিল এই পথ হারানো, এই ভুলভুলাইয়ার চক্কর, এই কুয়াশা...
কুয়াশা
বলতেই বিদ্দুচ্চমকের ঝলকানির মতোই মনে পড়ে গেল সুখরামের কথা, মজবুড়োর সাবধানবাণী। সমস্ত
চেতনা জুড়ে আবারও চলার প্রবল তাগিদের প্রতিরোধে অলক এই হেমন্তের সন্ধ্যাতেও ঘামতে
থাকে। শেষে অবাধ্য পা দুটিকে সংযত করতে বসেই পড়ে গাছতলায়। তার এই কাজের প্রতিবাদেই
হয়তো গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে থাকে এক অনৈসর্গিক শিশু। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে অলক।
সহ্যের প্রান্তসীমায় আসার আগে তার মনে পড়ে, শকুনের বাচ্চার কান্নার আওয়াজও এইরকম।
বুক থেকে একটা লম্বা শ্বাস বের হয়। এবার একটু সাহস আসে মনে। হেলান দিয়ে বসে গাছের
গুঁড়িতেই। সারাদিন গরম হবার পর মোরাম ঠাণ্ডা হতে থাকে। রাতের নানান আওয়াজের সাথে
সে আওয়াজও মিশে যায়। অলক মাথা স্থির রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় শুধু জপে যায় –
“Logic, Alok, apply logic.”
কুয়াশা, হিমভেজা রাত, পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসের মতো
হাওয়া,পেঁচার ডাক সব ধীরে ধীরে হার মানে। মাথার ওপর তারারা আবার জ্বলজ্বলে হল কি?
ঘুমিয়ে পড়ল অলক।
সকালে ঘুম ভাঙল যখন, তখন ঝলমলে রোদ্দুর। বাড়িটা এবার পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
দ্রুত পা চালাল অলক।
No comments:
Post a Comment