Sunday, December 30, 2018

ঈশ্বর, নদী এবং ভালোবাসা ( সিকিমের লোককথা অবলম্বনে)


বিশাল বরফের ঢালু প্রান্তর। তার হেথায় হোথায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কালচে সবুজ অথবা দুধসাদা পাহাড়ের দল। গভীর খাদে মৃত্যুর হাতছানি বড় স্পষ্ট। বিপদ-সংকুল এই তিস্তা কাংশে হিমবাহের ওপারে গলানো রুপোর ঔজ্জ্বল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই অঞ্চলে অবিসংবাদিত দেবতা কঞ্চেন কঞ্চলো
সেই হিমাবহের মাঝে এক পান্না সবুজ হ্রদ, নাম তার চো লামু। চারিদিকের এই নিস্তব্ধতাকে খান খান করে চো লামুর বাঁধন ভেঙে হাসি রাশিতে উচ্ছল এক কিশোরী চপল পায়ে নেচে যায়। পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে ঝাঁপ দেয় গহীন খাদে। আবার সেই মৃত্যুশীতল আঁধার কেটে প্রবল শোরগোল তুলে বেরিয়েও আসে। আবার দৌড়, আবার ঝাঁপ এইভাবেই চঞ্চলা কিশোরীর মতোই চিরসবুজ রংনিয়ো, নদীর রূপ ধরে বয়ে চলে সিকিমের মাটি ছুঁয়ে।

একা? একেবারেই নয়। চো লামু থেকে আরেকটু পশ্চিমে আরও গভীর দুর্গম এক হিমবাহ থেকে বেরিয়ে এসেছে রঙ্গিত। নীলকান্তমণির মতো নীল তার জল। বড় রহস্যময় তার গতিবিধি। ঠিক কোথা থেকে যে সে এসেছে তা কেউ জানে না। নিজের চলার পথ সে নিজেই তৈরি করে নেয়। চেনা ঢালে, তৈরি পথে চলে সে সুখ পায় না। আর সবাই যখন দক্ষিণদিকের সোজা ঢাল দিয়ে বয়ে যায়, সে তখন চারিদিক ভালো করে দেখার নেশায় কখনো দক্ষিণ কখনো পূর্ব আাবার কখনো বা পশ্চিম দিকেও ছুট লাগায়। এই কিশোরটির উপর রংনিয়োর কেন যে এতো টান! তার নীল রঙের মাতনে এই শ্যামলা কিশোরীটির বুকে দোলা লাগে।

তা, রঙ্গিত কখনও একটু থিতু হয়ে বসলে তো! কোথায় পাহাড়ের কোল আলো করে রেখেছে নানা রঙের অর্কিড; কোন ফাঁক দিয়ে মুখ বের করলেই চোখের সামনে ঝলমল করে উঠবে  কঞ্চেন কঞ্চলোর রাজসিংহাসন; কিম্বা কোথায় সবুজ পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে জল খেতে আসে পাহাড়ী হরিণের দলতার চলন তো সেদিকেই! যতই এসব দেখুক রঙ্গিত, দিনান্তে একবার রংনিয়োর মুখটা না দেখলে চলে না তার। সন্ধ্যা নামলেই জল ছেড়ে ওঠে রঙ্গিত, ছুটে আসে রংনিয়োর কাছে। গাছের দল পাতার চাদর বিছিয়ে দেয়, ডালের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ে চাঁদের আলো। বিশ্বচরাচর যখন ঘুমায়, তখন এই দুটি নদীর প্রাণ পাশাপাশি বসে। সারাদিনের গল্প বলে। বিভোর হয়ে শোনে ওর কথা। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে যায় যে যার আপন জায়গায়। রঙ্গিত বুঝতেই পারে না কেন এই আকর্ষণ! তার চঞ্চল মন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পালাতে চায় আরো অনেক দূরে। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ফিরে ফিরে আসে। রংনিয়োর শ্যামল শান্ত মুখখানি না দেখে কিছুতেই থাকতে পারে না যে!

তা কথার পিঠে কেবল কথাই হয়ে চলে নাকি? কথার হাত ধরে মনের সাথে মনও মিলে যায় কোন সময়। একদিন রংনিয়ো বলে,
-       এবার একটু নিয়মতে চলো রঙ্গিত। তুমি এভাবে চললে সমতলে নামতে নামতে এতদূরে চলে যাবে যে হারিয়ে ফেলব তোমায়।
-       কি যে বলো? আমি তো আগেই পৌঁছে যাব সমতলে। সেখানে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি এলে পাশাপাশি বয়ে যাব তখন।
-       তাই বুঝি? আমি তোমার চেয়ে জোরে ছুটতে পারি মশাই। নীচে নেমে আমিই বরং তোমার অপেক্ষায় দিন গুনব!

হাসিখুশির মধ্যে শুরু হওয়া এই গল্পটা কেমন যেন হঠাৎ করেই প্রতিযোগিতার রেশারেশিতে বদলে গেল। রঙ্গিতের পৌরুষের গর্বে, গতির অহংকারে কোথায় যেন ঘা লাগল। জেদী ঘোড়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বললঠিক আছে। তাহলে শুরু হোক দৌড়। সমতলের প্রথম গ্রাম পোজক। সেখানে যে আগে পৌঁছাবে সেই জিতবে। আর সে অপেক্ষা করবে আরেকজনের জন্য।

হয়ে যাক তাহলেরংনিয়োর ঠোঁট ফুলে উঠল অভিমানে।

যাক তো বটে। যাবে কি করে? পোজকের পথ কেউ চেনে না। অগত্যা তারা চলল কঞ্চেন কঞ্চলোর কাছে। তিনি সব শুনে রায় দিলেন  নিজের নিজের পছন্দমতো পথের দিশারী খুঁজে নাও। আমিও দেখতে চাই কার জিত, কার হার!

রংনিয়ো ডাক দিল সাপের দেবতা পারবুকে। পারবু রাজি হল। তাই দেখে রঙ্গিতের কী হাসি! সে জানে এর চেয়েও তাড়াতাড়ি সোজা পথে যেতে পারে তাত-ফো। পাখিদের এই রাজাটির সঙ্গে তার ভারি ভাব। সেই তো সিকিমের সব সুন্দর সুন্দর জায়গার হদিস এনে দিত রঙ্গিতকে। বলতেই এককথায় রাজি হয়ে গেল তাত-ফো।

সাপ যেমন যায়ডাইনে, বাঁয়ে না তাকিয়ে সরসর করে সহজ রাস্তায় চলে যায় পারিবু। আর তার পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে খেলার মাঠ, নতুন রাস্তাঘাট পেরিয়ে যায় রংনিয়ো। সিকিম ছাড়িয়ে বাংলায় ঢোকার মুখে তার দেখা হল রংপোর সঙ্গে।

-       বন্ধু হবে আমার? – বলেই সে মিলে গেল রংনিয়োর জলে।
বন্ধুর হাত ধরে আরো গতি বাড়ল রংনিয়োর। খুব তাড়াতাড়ি ছুঁয়ে ফেলল সমতলের মাটি। কিন্তু কোথায় রঙ্গিত? সে তো এখনও এসে পৌঁছায়নি! কি আর করে রংনিয়ো। অপেক্ষা করতে থাকল বঁধুর জন্য।

সত্যি তো! কোথায় গেল রঙ্গিত? সেও তো ছুটছিল তীব্র গতিতে তাত-ফোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আকাশ দিয়ে উড়ে যায় তাত-ফো। তার চোখে পড়ে ফুলে ফলে ঢাকা উপত্যকা, সবুজ ঘাসের মধ্যে উদ্ধত রডোডেনড্রনের দল, কুয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া রাস্তাথমকে দাঁড়ায় অমনি। সেদিক পানে উড়ে যায়। রঙ্গিত পিছু পিছু চলে দেখার নেশায় অজান্তেই সময় গড়িয়ে যায় টুপটাপ। প্রাণভরে পান করে সুন্দরের মদিরাআর চলতে থাকে। কিছুদিন বাদে তাত-ফো আর রঙ্গিত এসে পড়ল একটু ফাঁকা জায়গায়। সেখানে রাম্মানের সঙ্গে তার দেখা হালকা সবুজরঙা রাম্মান রঙ্গিতের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতেই – রঙ্গিতের মনে পড়ে যায় রংনিয়োর কথা, সেই প্রতিযোগিতার কথা। রাম্মানকে পেয়ে রঙ্গিত আরও শক্তিশালী হল। এবার আর কোনদিকে না তাকিয়ে সে দৌড়ে চলে সমতলের উদ্দেশ্যে। চলতে চলতে হঠাৎ কানে এল অনেকদিনের চেনা সুর। এই কলধ্বনি যে তার বহুযুগের চেনা। স্বর তার রংনিয়োর! দৌড়ে গেল খাদের ধারে। উঁকি মেরে দেখল বেশ অনেক নীচে সমতল দিয়ে বয়ে চলেছে রংনিয়ো! ওপর থেকে হাঁক পাড়ে রঙ্গিত – থিস সি থা? কখন পৌঁছেচ?

রংনিয়োর পান্নাদ্যুতি হাসিটাই রঙ্গিতকে বুঝিয়ে দিল বাজিটা সে হেরে গেছে। অবুঝ দুরন্ত রাগে সে ফিরে যেতে চাইল – যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরে। কিন্তু চাইলেই কি আর সময়সারণির উল্টোপথে চলা যায়? ফুঁসে উঠল রঙ্গিত, তছনছ করে দিতে চাইল পাহাড় বন সব স-ব। এই তাণ্ডবের মধ্যে বারবার রংনিয়োর মধুর স্বর বাজতে থাকল – রঙ্গিত আমি তোমারই অপেক্ষায় বসে আছি। শুধু তোমারই জন্য।

শান্ত হয়ে এল পুরুষের অভিমান। প্রতিযোগিতা নয়, রংনিয়োর ভালোবাসার টানেই যে সে এখানে এসেছে, একথা বুঝতে এত দেরি হল তার? আর এক মুহূর্তও নয়, সে ওপর থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তার আদরের রংনিয়োর বুকে।

নাহ্। রংনিয়ো নয়, দীর্ঘ অদর্শনের পর যে ডাক বেরিয়েছে প্রিয় মুখ থেকে – তাই আজ তার অভিধা। সে আজ থেকে তিস্তা!

উজ্জ্বল নীল জল আছড়ে পড়ল সবুজ জলে। যেন পেখম খোলা ময়ূরের নাচ! রত্যাতুরা রমণীর মতো থরথরিয়ে কেঁপে উঠল তিস্তা। ফিসফিসিয়ে শুধালো,
-       এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিলে কেন?
আর এতোদিন বাদে তিস্তার কানে কানে সেই আশ্চর্য শব্দবন্ধটি উচ্চারণ করল রঙ্গিত – ভালোবাসি, তাই।

কঞ্চেত কঞ্চলো হেসে উঠলেন। তাঁর বরফের মুকুট ছোঁওয়া রোদ নীচে নেমে এসে দুটি ভালোবাসার প্রাণকে আশীর্বাদ করল। অমর হয়ে রইল তাদের প্রেমগাথা। আজও নববিবাহিত দম্পতি কিংবা প্রণয়ীর দল এই সঙ্গমে স্নান করে চিরমিলনের আশীর্বাদ নেয়।

No comments: