বড় শান্ত নদীটি।
কূল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে যায়। শান্ত এক মেয়ে। কাজলকালো তার চোখ। ভীরু ভীরু পায়ে সে
পার হয়ে আসে তার শৈশব, তার কিশোরী বেলা। সমনামী বলেই নদীটির সাথে তার এত ভাব কিনা
কে জানে ! কেন জানি ওর মনে হয় এই নদীর সাথে ওর বড্ড বেশী মিল।
কূল না ভেঙে, বেশী উচ্ছ্বল না হয়ে, “do and don’ts” এর সব বিধিনিষেধ মেনে চলতে চলতেই এল কৈশোর যৌবনের
সন্ধিক্ষণ। মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যায় ময়ূরাক্ষী – পড়ায় ভুল হয়ে যায় তার। বড় ইচ্ছে
করে ময়ূরাক্ষীর – এমন একজন কেউ আসুক যে তার পাশ দিয়ে আনমনে চলে যাবে না ; একটু পা
ভিজোবে – হাত দিয়ে ছিটিয়ে দেবে এক আঁজলা জল – কিংবা ---
নাঃ, এর বেশী
কিছু ভাবারই সাহস নেই তার ! ছোট থেকে মেনে আসা বারণের দরজাগুলো না পেরোতে পেরোতে
কখন যে তার ডানাদুটোই ছোট হয়ে গিয়েছে – নিজেও জানে না বেচারী।
তবু, কখনো কোন
ঝকঝকে তরুণের তীব্র উপস্থিতি তাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। চুরি করে খাওয়া আচারের
মতোই এক তিরতিরে ভাললাগায় শিউরে ওঠে। কিন্তু বাঁধনহারা বোহেমিয়ান তারুণ্যকে
“খারাপ” তকমা দিতেই যে জেনে এসেছে আজ অবধি, তার বেড়াটা যে বড্ড শক্ত।
এমনি ভাবেই যায়
যদি দিন যাক না – গোছের একটা আলোআঁধারির মধ্যে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিল তার পলাশরাঙা
দিনগুলি। কিন্তু কি করে কে জানে, তারই মতো এক ভীরু কিশোর, অনবধানের ছোট্ট দরজা
পেরিয়ে পৌঁছে গেল তার বালুকাবেলায়। আস্তে করে হাত রাখল তার জলে। ভয় পেল ময়ূরাক্ষী,
ঝিলমিলিয়ে উঠল,আবার পালাতেও চাইল বোধহয়। কিন্তু ফিরে এল পরের ঢেউয়েই।
এই মন ছুঁইমুই
খেলতে খেলতে কখন বুঝি একটু অসাবধান হয়েছিল ময়ূরাক্ষী। বোধহয় জোছনরাতে জোয়ারে জল
একটু বেশী ফুলে উঠেছিল – বন্ধ কারার প্রহরীদের চোখে ধরা পড়ে গেল সে।
বাঁধের বাঁধনে
বাঁধা পড়ে গেল ময়ূরাক্ষী।বিয়ে হয়ে গেল তার। এক স্বচ্ছল যৌথ পরিবারের বড়বৌ সে এখন।
তিলপাড়ার ড্যামের জল এখন নানা ক্যানেল দিয়ে বয়ে যায়। কারো চাষের জমিতে জল দেয়, আলো
জ্বালায় অন্য কারো জীবনে। বড়বৌয়ের
সুখ্যাতিতে সবাই পঞ্চমুখ। বাঁধের অন্যধারে নদীটি যে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে তা
কেউ দেখে না, কিংবা দেখলেও গ্রাহ্য করে না। সরকারী অফিসের বড়বাবুটি লোক ভাল। বছরে
দু-বছরে একবার বেড়াতে নিয়ে যান, কিনে দেন দামী শাড়ী, মাঝে মাঝে গয়নাও। এমন কি
রান্না খারাপ হলে অথবা অফিস যাবার সময় রুমালটি না পেলে রাগারাগিও করেন না। ভালই
আছে ময়ূরাক্ষী – জীবনে আর কি চাই !
এভাবেই দিন কেটে
যায় – আয়নার সামনে নিজের মুখোমুখি হবার সময় পায়নি সে বহুদিন। বড় সংসার আস্তে আস্তে
ছোট হয়ে আসে। দেওর-ননদ-ছেলে-মেয়ে সবাই যে যার নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শ্বশুড় শাশুড়ীও গত হয়েছেন কিছুদিন হল। সংসার বলতে সে আর তার ভালমানুষ বরটি। সকলকে
ভাল রাখতে গিয়ে যে নিজের কথা ভাবার অবকাশ পায়নি কখনো, আজ তার হাতে অখণ্ড অবকাশ।
এমনই এক সময়ে তার হাতে এল স্মার্টফোন। খুলে গেল
এক কল্পদুনিয়ার দরজা। ময়ূরাক্ষী দেখল, এই দুনিয়ায় সে ঘুরে বেড়াতে পারে নিজের
ইচ্ছেমতো। আসলী দুনিয়ার লোক তার এই ভ্রমণের আঁচটিও টের পাবে না !!
পুরোন নতুন কত্তো
বন্ধু এখন তার ! যে কথা সে মুখে বলতেই পারত না কোনদিন, তারা দিব্বি এসে যায় আঙুলের
ডগায়। যে শান্ত ভীরু মেয়েটিকে লক্ষ্যই করত না কেউ, সাহসী আঙুলের জোরে সেই হয়ে
উঠেছে কল্পদলের মধ্যমণি।
এরকম সময়েই তার
আলাপ অজয়ের সাথে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত সফল সুখী এক পুরুষ। বড় ভাল লাগে ময়ূরাক্ষীর।
অজয়ের সহানুভূতিময় বন্ধুত্ব পূর্ণ কথা, হাল্কা রসিকতা, সুভদ্র রসবোধ এসবই তাকে
নিয়ে যায় অন্য উজানে। অনেক নতুন নতুন পৃথিবীর সাথে চেনা হয়ে যায় তার। আর কবেই বা এসবের স্বাদ পেয়েছে সে ! কিন্তু
ভুলে যায় ময়ূরাক্ষী – অজয়ের স্রোত বড় তীব্র। কিংবা হয়ত সেই তীব্রতাটাই মাতন ধরায়
তার প্রায় মোহনার কাছে পৌঁছে যাওয়া জলে। অজয় টের পায় এই অসহায়তা। প্রকৃত বন্ধুর
মতোই সে নানা খাতে নানা ধারায় সেই জলকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। তবু চোরাস্রোতে
জল জমে ময়ূরাক্ষীর বুকে। জমতেই থাকে ----
কোন একদিন বাঁধ
যদি ভাঙে, দুকুল ভাসিয়ে বয়ে যাবে ময়ূরাক্ষী। যদি – কোনদিন – যদি - ---
*
*
*
অজয় খুব চিন্তায়
আছে।
No comments:
Post a Comment