‘ডাকছে তোমায় তাই যদি হয়, তাহার কাছে যাও
কাছে গিয়েও আপন ছাড়া, কারেও নাহি পাও।’
ধাঁধা যে কি ধন্দের সৃষ্টি করতে পারে তা কি আগে জানতাম! পরিস্থিতি শিখিয়েছিল - আয়নার ধান্দাবাজি! হ্যাঁ মশাই, নাকের জলে চোখের জলে।
আমরা এসেছি জয়পুরে, বিষ্ণুপুরের কাছে। তখনো সেটা ট্যুরিষ্ট স্পট হয়ে ওঠেনি। ইউক্যালিপটাস আর শাল জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট কোয়ার্টার। খুব বাজে আর অসুবিধাজনক প্ল্যানিং . তাই ব্যাজার মুখেই মানিয়ে নিতে হচ্ছিল। একটাই সুবিধা- ইলেক্ট্রিসিটি ছিল। একটাই আনন্দ
– ঘরের আশেপাশে অনেক পাখি। যথারীতি আমার আর ভাইয়ের “mission
birds” শুরু হয়ে গেল। মার প্রবল আপত্তি সত্তেও ঘরের ভিতরের বিশাল খোলা চাতালে ধান,
চাল ছড়ানো শুরু হল। পাখিরাও এল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অন্য পাখিদের তাড়িয়ে রাজত্ব দখল করল চড়ুইয়ের দল। আমরা বসে বসে মজা দেখতাম। কিছুদিনের মধ্যেই চড়ুয়ের দল চাতাল ছেড়ে ঘরের দখল নিতে লাগল। সারাদিন তাদের কিচিমিচি,
মন্দ লাগত না। মা যে কেন গজগজ করতেন মাই জানেন। আমরাও জানলাম,
শীত কমে বসন্তের আভাস আসতেই।
“ঠাণ্ডা লাগবে বলে এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু এখন থেকে তোমাদের পাখির নোংরা তোমরাই সাফ করবে”।
ঠাণ্ডা গলার আদেশে পরিষ্কার কোন ট্যাণ্ডাই ম্যাণ্ডাই চলবে না। বাবাও দেখি চুপ। হিংসুটে পাখিগুলো কিছুদিন আগে বাবার শখের ‘জলখাওয়া কাঁচের পাখি’টার দফা রফা করেছে। অতএব কাজ শুরু। দেখা গেল প্রথমে যত সোজা ভেবেছিলাম,
ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। চড়াইদের কোন স্থানজ্ঞান নেই। দুদিনেই পক্ষীপ্রেম তলানিতে ঠেকল। চুপিচুপি ভাইবোনে বলাবলি করি,
‘মার কথা তখন শুনলেই ভাল হত রে।‘ কিন্তু বাবা-মার সামনে বীরদর্পে সাফাই করি। প্রেস্টিজ কা সওয়াল। তখন কি আর জানি যে এ সবে কলির সন্ধ্যে!
গরম আর একটু বাড়তে পাখা চলল। কি আনন্দ!
হাতপাখা নাড়তে হচ্ছে না। কিন্তু চড়াইরাই বা কেন দুপুরের কাঠফাটা গরমে বাইরে থাকতে যাবে?
এক-দুই করে তাদেরও আসা শুরু হল।
চিত্তির! ঘরে ঢুকলে যতই তাড়া দিই না কেন,
পাত্তাই দেয় না। এই কয়মাসে তারা বুঝে গেছে আমরা নেহাৎ দুর্বল প্রতিপক্ষ। তাদের অনিষ্টসাধনের যোগ্য নই!
অগত্যা পাখা বন্ধ করে ঘামি। পাখার ব্লেডে ধাক্কা খেলে তো আর দেখতে হবে না। দাঁত কিড়মিড় করে হাতপাখা নাড়ি। কিছুদিনের মধ্যেই পিরিসটিজের নিকুচি। শেষে বাবাই বুদ্ধি দিলেন।
যে ঘরে আয়না-চিরুনি,
বাক্সেরা থাকত তার একটা গালভরা নাম দিয়েছিলাম
– ড্রেসিংরুম। তা সে ঘরে মুখোমুখি দুটো বড় আয়না থাকত। এছাড়া বাবার সেভিং সেটের আয়নাটাও মোটামুটি বড়ই। সেটাও একটা বাক্সের উপর সেট করা হল। তিনটে আয়নার সামনে একটু ধান ছিটিয়ে রাখা হল। দুপুরে চড়াই এলে তাদের তাড়িয়ে ঐ ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। খানিক পরেই শুরু হল ধুন্ধুমার। ধান খেতে গিয়ে দেখে আরেকটা চড়াই ধান খাচ্ছে!
আর যায় কোথায়!
আর দেবো না আর দেবোনা,
ধান মোদের প্রাণ হো – বলে সে কি লড়াই!
একবার এই আয়নায় ঠোকরায় তো পরমুহূর্তে ওটায়। আমরা জানলার বাইরে থেকে ওদের কাণ্ড দেখছি। দুতিন ঘণ্টা বাদে উঁকি দিয়ে দেখি চার বাবাজীবনই নেতিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে একটু মুণ্ডু উঠিয়ে প্রতিপক্ষকে ঠোকরাচ্ছে। ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে বেশ ব্যথা হয়েছে বোঝা গেল। বাবা বললেন এবার ছেড়ে দে।
দরজা জানলা খুলে ওদের বাইরে নিয়ে এলাম। জলটল খেয়ে একটু সুস্থ হতেই উড়ে গেল। বন্ধুদের কী বার্তা দিয়েছিলো
তারাই জানে। তবে সেই থেকে আর ঘরে ঢুকত না কেউ। মা ঠিকই বলতেন
– ‘সর্বমত্যন্তম্ গর্হিতম্’। জীবপ্রেমেরও সীমা থাকা জরুরী।
No comments:
Post a Comment