আমার এই বনধুটির নাম মহারাজ। বনধু হলে হবে কি, এর মত হাড়বজ্জাত টিয়া আমি বাপের জন্মে দেখিনি।
শব্দটা ভেবেচিন্তেই লিখলাম, কারণ আমার বাবাও একই কথা বলতেন। শুধু ভাষা সম্বন্ধে খুতখুঁতে ছিলেন বলে বলতেন এত দুষ্টু টিয়া জীবনে দেখিনি।
মহারাজকে প্রথম দেখি এক সকালের জলখাবারের আসরে। তখন আমরা বেলপাহাড়ীতে থাকতাম। জলখাবারটা আমাদের বাড়ীতে সবাই মিলে বেশ জমিয়ে খাওয়া হয় চিরকালই। সেরকমই এক আসরে কোথা থেকে কে জানে, লটপট করতে করতে উড়ে এসে জুড়ে বসল সামনের উঠোনে। এদের নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতা একটু বেশীই। কাজেই মার বকুনি শুনতে শুনতেই তাকে লুচির ভাগ দিতে গিয়ে ভাই আবিষ্কার করল টিয়াটার পায়ে চোট আছে। বাবা ভাল করে দেখে বললেন ‘আরে এতো কারো পোষা টিয়া, ডানাটা একটু ছাঁটা দেখছি’। কি খারাপ কি খারাপ! বাবার অফিস, কাজেই কি করতে হবে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে বাবা চলে গেলেন। ঠিক হল এ হবে আমাদের “ছাড়া-পোষা” টিয়া। নামকরণও হয়ে গেল – মহারাজ। এবার তার সাথে ভাব জমাবার পালা। ওর খুব খিদে পেয়েছিল, আর মানুষের সঙ্গতে অভ্যস্তও; কাজেই বিশ্বাস অর্জন করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। পায়ে ওষুধ লাগাবার সময় আপত্তি করছিল একটু একটু। তবে জোরে ঠোকরায়নি একবারও! দুপুরের দিকে তাকে ধরতে দিল ভাল করে। তখন তাকে আমাদের কোয়ার্টারের সামনের মস্তবড়ো জালঢাকা বারান্দায় নিয়ে যেতে পারলাম। সেখানে ওনিরাপদে থাকবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।
আজ বড় আনন্দের দিন। সারা সকাল কেটেছে মহারাজের সঙ্গে। পড়াশোনা চুলোয় যাক, স্নান পর্যন্ত হয় নি। মা একটু রাগ করছেন বটে কিন্তু তার পুরোটা সত্যি নয় সেটা আমরা বেশ জানি। মহারাজের খাবার জলের বাটি সব তো মা-ই দিলেন। এরপর থেকে মহারাজ বেশ পোষ মেনে গেল। ওষুধ লাগাতে আপত্তি করত না। আমাদের সাথে খেলত। জলখাবারের আসরে সে আমাদের নিত্যসঙ্গী।
কিছুদিন বাদে বাবা বললেন এবার মহারাজকে ছাড়ার সময় হয়েছে। তার ডানা সেরে গেছে। মহারাজকে বাইরে এনে উড়িয়ে দিতে সে প্রথমটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সামনের টগর গাছটায় বসে রইল। তারপর এদিক ওদিক দেখে এক দুবার ডানা ঝাপটে ঘাড় বেঁকিয়ে আমাদের দেখল। তারপরেই ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে উড়ে গেল কোথায় কে জানে। আমাদের চোখে জল মুখে হাসি- ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কোন অনুভূতিটার জোর বেশী।
পরদিন সকালে খেতে বসেছি। খেতে খেতে ভাই একটু একটু চোখের জলও মুছে নিচ্ছে – হঠাৎ ট্যাঁ ট্যাঁ, ঝটপট। ও মা গো, মহারাজ এসেছে। আলু লঙ্কার ভেট চড়ল। তিনি খেয়ে দেয়ে ওড়ার ক্যারদানি দেখিয়ে উড়ে গেলেন। এরপর থেকে তার নিত্য হাজিরা সকালের আসরে। আলু না দিলেই সে কি রাগ আর চ্যাঁচানি। বেছে বেছে বাবার জলের গেলাসের ঢাকা মুখে তুল নেবে। আলু দিতে দেরী হলে ঠুকরে ঠুকরে সেটার বারো বাজিয়ে ছাড়বে। কি করে বুঝেছিল কে জানে জলের গ্লাস-ঢাকাটা বাবার একটা দুর্বলতা!
এভাবেই চলছিল। একদিন দেখি মহারাজ তার বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। সেটার আবার ঠ্যাং ভাঙা। বাবা বকুনি দিলেন, আমার বাড়ী কি তোদের হাসপাতাল? কি বুঝল কে জানে, বাবার জলের ঢাকনির দিকে তেড়ে গেল। অগত্যা মহারাজের বনধুর সেবায় লাগলাম। কিনতু এতো বনের টিয়া। কাজটা সোজা নয় মোটেই। তবে মহারাজ সাহায্য করল খুব। রীতীমতো ঠুকরে ওকে বুঝিয়ে দিল বেগড়বাই করা চলবে না।বলতে গেলে ওর সাহায্যেই ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, আর সামনের বারান্দায় নিয়ে যাওয়া। মহারাজ রোজ আসত খবর নিতে।
হঠাৎই একদিন ওর আসা বন্ধ হয়ে গেল। খোঁজ করে জানতে পারলাম, তার পূর্বতন ‘মালিক’ তাকে খুঁজে পেয়েছে এতদিন বাদে। আর ধরেও নিয়ে গেছে। বাড়ীর খোঁজও পেয়েছিলাম। বন্দী মহারাজকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করেনি আর। মহারাজের বনধু ভাল হয়ে একদিন উড়ে গেল। আশাকরি তাকে কেউ বন্দী করবে না।
No comments:
Post a Comment