তারে আমি চোখে দেখিনি,
শুধু গল্প শুনে
– না:
অল্প নয় অনেক ভালবেসেছি,
তার ছবিতে হাত বুলিয়ে চোখ উপছে জল ঝরিয়েছিও অনেক
– আজও তার কথা হলে গলার কাছে ব্যথা। তার নাম ‘শিউজী’,
বনবিভাগের গর্বের মহাকাল।
একটু দুর্বোধ্য হয়ে গেল কি?
বিশাল দুদাঁতওয়ালা পুরুষ হাতীকে মহাকাল,
দাঁতহীন হাতীকে মাকনা আর একদন্তী হাতীকে গণেশ বলত ওখানে।
শিউজীর চেহারা ছিল বিশাল,
শক্তিও ছিল অপরিসীম। পোষা দলের তো বটেই,
বুনো হাতীদের উপরও চলত তার সর্দারি। জলদাপাড়া বা গরুমারার জঙ্গলের একছত্র রাজা ছিল শিউজী। ওই এলাকায় অন্য দাঁতাল ঢুকলে মেরে ভাগিয়ে দিত তাকে। একবার জঙ্গলে এল আর এক মহাকাল। সেও বেশ শক্তিশালী। ফলে হামেশাই লড়াই বাঁধতে লাগল। শিউজী হরবার জিতত। কিন্তু আগের মহাকালগুলোর মতন এই মহাকালটা কেন জানি অন্য জঙ্গলে চলে গেল না। অন্যপক্ষে শিউজীকে সামলানো কারো ক্ষমতার বাইরে।বনকর্মীদের অবস্থা করুণ। এদিকে মহাকালের দুটি মাকনা বান্ধবী জুটেছে। ফলে শিউজীর উপর প্রায়ই ত্রিমুখী আক্রমণ চলে। কিনতু শিউজী অপরাজেয়। একদিন এক ভয়ঙ্কর লড়াই চলল বহুক্ষণ। জয়ী হলেও শিউজী আহত হল ভালরকম। মহাকালটিও চোট পেয়ে গা ঢাকা দিল। শান্তি ফিরল বনে।
শিউজীর চিকিৎসা চলছে। সে যাতে জঙ্গলে না যেতে পারে সেজন্য তার চারপায়ে শিকল। রাতে তার চারপাশে থাকে আগুনের বেড়া। একদিন হঠাৎ শিউজী খুব অস্থির হয়ে উঠলো। বাঁধন ছেড়ার চেষ্টায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষতও করে ফেলল। ওর এই অস্থিরতার কারণ বোঝেনি কেউ। সবাই ভাবল এ ওর মস্তানি। শিউজী সবার বড় প্রিয়।
যাতে সে আবার জঙ্গলে গিয়ে নিজেকে আরও আহত না করতে পারে, সেজন্য আরো শক্ত হল ওর বাঁধন। ওষুধপত্র দিয়ে রোজকার মত আগুন জ্বেলে রাতে সবাই ঘুমাতে গেল। কপাল খারাপ ছিল,
সেদিন কোন কারণে শেষরাতে আগুন নিভে গিয়েছিল। হঠাৎ হাতীদের তীব্র হুঙ্কারে সবাই দৌড়ে এসে দেখে এক বীভৎস দৃশ্য। দুই মাকনা দুপাশ থেকে চেপে আছে শিউজীকে,
আর মহাকাল তাকে দাঁতের আঘাতে আঘাতে ফালাফালা করে দিচ্ছে। বাঁধা শিউজী তার জীবনের শেষ লড়াইটা লড়তেই পারল না। চার হাতীর সেই মরণপণ লড়াইয়ে রেঞ্জ অফিসার, বীটঅফিসার কাকুরা দূরে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো ছটফট করলেন। কারণ লালফিতের আজব আইনে ঘুমপাড়ানি গুলি থাকে কলকাতায়। রিকুইজিশন করে আনাতে হয়। এখন নিয়ম কি হয়েছে জানিনা। যেভাবে লড়াই চলছে তাতে
গুলি করে মারাও সম্ভব নয়। কারণ নির্দিষ্ট স্থানে গুলি না লাগলে হাতী মরবে তো নাই,
উলটো বিপত্তি হবে।
শিউজী মারা গেল পরদিন। বাকী পোষা হাতীরা দুদিন ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ওর কবরের পাশে।
উত্তরবঙ্গের অনেক বনবাংলোতেই শিউজীর ছবি টাঙানো আছে। যদি বুড়ো ওয়াচম্যান থাকে, তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে নিশ্চয় শোনাবে শিউজীর গল্প – আমার চেয়ে অনেক ভাল করে।
No comments:
Post a Comment