Friday, September 8, 2023

চিরসখা হে ||দোলা সেন||



গাছের কাণ্ডটা হেলে রয়েছে অনেকটাই। ডালপাতার আড়ালে ঘেরা একান্ত শয্যা যেন। এই মুহূর্তে চারপাশ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে একালাযাপনের তৃষ্ণা প্রবলভাবে অনুভব করছেন তিনি। পরম আদরে হাত বোলালেন গাছটির গায়ে। শাখা নুইয়ে গাছটি অভিবাদন জানাল কি? ভাবনাটা মনে আসতেই একটুকরো হাসি খেলে গেল ওঁর মুখে –
তুঁহু জগন্নাথ, জগতে কহায়সি –
যুগ যুগ বাহিত এই বোধ কি‎ তিনিই জাগাননি? বস্তুতঃ তিনি যে সর্ব জীবের অধীশ্বর, বিশ্বচরাচর যে তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই আবর্তিত – এই ধারণা তো সবার মতো তাঁর মনকেও অধিগ্রহণ করেছিল। পথ চলতে চলতে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, এ তাঁর মানবজনম। মরমানুষের দায়, ভ্রান্তি, সুখ, দুঃখ – সব বহন করার শর্তেই, পৃথিবীর মাটিতে তাঁর অবতরণ। ধরার ধূলির অংশ হওয়া - তাঁর স্বলিখিত বিধিলিপি।
পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান হানাহানি, হিংসা, বিভেদ – সবকিছুই যুগের পালাবদলের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। দ্বাপরের অবসানে কলির পদার্পণে ধ্বংসের সূচনা ধ্বনিত হবে। এই শ্যামলে সুনীলে শোভিত ধরণী প্রলয়পয়োধিজলে নিমগ্ন হবে আবার। কষ্ট পেয়েছিলেন পালনহার। এই ধরণীর মাটি তাঁর বড় প্রিয়। সেই প্রিয়ের বিনাশ ঠেকাতে যুগের অনুক্রম বদলে দিতে চেয়েছিলেন। এই ধরারই একজন হয়ে এই কাজ করে দেখাতে চেয়েছিলেন বনমালী।
অখণ্ড বিশ্বাস ছিল নিজের প্রতি। ভেবেছিলেন তাঁর নিজের বংশ, তাঁর রক্তধারা যেখানে বাহিত হবে সেখানে শুধু সত্য, শিব আর সুন্দরেরই আসন পাতা থাকবে। এই ভাবনার শিকড় এতটাই দৃঢ়প্রোথিত ছিল যে, তাঁর জন্মসময় থেকে বিকাশের জন্য যে অবিচার হয়ে চলেছিল – সেগুলোকে খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এমন কি, জন্মের পরেই যোগমায়ার প্রতিস্থাপন ও বলি প্রয়োজনীয় বলেই মনে হয়েছিল তাঁর। তাঁর খোঁজে গোকুলময় নির্বিচার শিশুহত্যাতেও কোনো বিচলন বোধ করেননি। সাধের বৃন্দাবন ছেড়ে আসার পর মা যশোদার আকুল কান্না ও প্রতীক্ষাকেও মনের আড়ালে নির্বাসন দিয়েছিলেন সহজেই।
সহজে? জীবনের উপান্তে এসে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দ্বারকাধীশ স্বীকার করতে বাধ্য হলেন – যত সহজ কাঠিন্যই প্রকাশ করে থাকুন না কেন, কাজটি সহজ ছিল না একেবারেই। নিভৃত বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে কতো নিসঃঙ্গ মুহূর্ত – তার হিসেব তিনি ছাড়া কেউ জানে না।
আচ্ছা একবার, মাত্র একটিবারের জন্যেও কি ফিরে যাওয়া যেত না সেই পরমপ্রিয় স্থানে? নিজের মনেই মাথা নাড়লেন মহানায়ক – যাওয়া যেত না। মানুষী জন্মের মায়ার বাঁধন যে কত শক্তিশালী, তা তিনি জানেন। মা, প্রিয়া, বন্ধু – জগৎপতি হবার মূল্য তিনিও কম দেননি। ব্যথাবিদ্ধ হাসি ফুটল পরমপুরুষের মুখে। এ যন্ত্রণা কারো সঙ্গে ভাগ করে নেবার মতো নয়। তবু রুক্মিনী কিছুটা....। একমাত্র এই নারীর কাছেই কিছুটা ধরা পড়েছেন তিনি।
গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ
প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।
তবু সব কথা কি আর তাকেও বলা যায়? কংসবধের পর জন্মদাতাকে সিংহাসনে বসানো, তাঁর রাজ্য সুরক্ষিত করা, মাতা দেবকীর যন্ত্রণাময় প্রতীক্ষা – এসবের দায় মেটাতে মেটাতে কবে যে নতুন জীবনের পাকে বাঁধা পড়ে গেছেন, তা তাঁর নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। নতুন যৌবনের উন্মাদনা, নতুন কিছু গড়ার আনন্দ – উত্তেজনার পারদ ক্রমশঃ ঊর্ধমুখী হয়েছে। অবকাশ এতই কম ছিল যে নিজের মনের গভীরে ডুব দেবার সময় পাননি বিশেষ।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ধর্মসংস্থাপনার্থায়.....
কুরুক্ষেত্রের মহারণে সকল রাজবংশ নিঃশেষিত, ধীরে ধীরে ইন্দ্রপ্রস্থ, হস্তিনাপুর, দ্বারকা... সর্বত্রই যদুবংশের শাসন – ভেবেছিলেন এইবার বুঝি বিশ্রামের সময়। যুগচক্রের গতিরোধ করতে পেরেছেন অবশেষে। বড় তৃপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর মানবজন্ম নেওয়া সার্থক ভেবেছিলেন।
ম্লান হাসলেন বাসুদেব। ঈশ্বরেরও ভুল হয় তাহলে? পৃথিবীর অনাচার অভিচারের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তাঁর। কলি যে সেই ফাঁকে তাঁর বংশেই মদ, মোহ, মাৎসর্যের জাল ছড়িয়েছে, তা বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল। আর আজ এই সমুদ্রতীরে তাঁর স্বপ্নের বংশের ধ্বসলীলা দেখলেন সন্ন্যাসীর বৈরাগ্য নিয়ে। বলরাম দেহত্যাগ করছেন কিছু আগে। চাইলে তিনিও...
না, এই মুক্তি তাঁর জন্যে নয়। অনেক ভুল হয়েছে জীবনে, অনেক অন্যায় – তার জন্যে অসীম যন্ত্রণাময় মৃত্যু তাঁর প্রাপ্য। বৃক্ষশয়ান হয়ে তারই প্রতীক্ষা করছেন তিনি। কিন্তু কোথায় তুমি সেই পরম বান্ধব? এসো এইবার।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। রক্তকমলসদৃশ চরণ দুখানি পাতার অন্তরালের বাইরে ছিল। জরা ব্যাধের তীর সেখানেই...
তীব্রতম যন্ত্রণার সত্তেও তাঁর কানে আসছিল জরার হাহাকার কান্না। তীর বের করে ওষধি লাগাতে চাইছিল সে আকুল হয়ে। অতি কষ্টে হাত নেড়ে তাকে অশ্বস্ত করলেন। ভুবনমোহন হাসিটা হাসতে পারছেন এখনও!
করজোড়ে পদতলে বসে পড়েছে কানহার বহুপ্রতীক্ষিত হত্যাকারী। হাসছেন কানাই – কতোবড় বন্ধু তুমি আমার, সে তুমি নিজেও জানো না জরা।
বন্ধু! সরল নিঃসংকোচ বন্ধুত্বের স্বাদ বৃন্দাবন ছাড়ার পর আর কবেই বা পেলেন! সখ্যতার সঙ্গে সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা, আনুগত্য মিশে গিয়েছে প্রতিবার। ত্রিভুবনের রক্ষার দায় যাঁর, গোপবালকদের ছোট ছোট হাত সেই তাঁর রক্ষায় ব্যস্ত থাকত! আধখানা ফল খেয়ে বাকি অর্ধ এগিয়ে দেবার বন্ধু তো আর পাওয়া হলো না জীবনে!
বহু কাঙ্ক্ষিত আঁধার নামছে দুচোখ জুড়ে। নিঃসীম নৈঃশব্দে ডুবে যেতে যেতে আড়ষ্ট জিহ্বায় ননীর স্বাদ পেলেন ননীচোরা। শরীরের দহন স্তিমিত হয়ে আসছে। তাঁর সারা গায়ে দুহাতে ননী মাখিয়ে দিচ্ছে শ্রীদাম, দাম, মধুমঙ্গলেরা। কপালের ওপরে হাতটি কি সুবলসখার? দূর থেকে বাঁশি সুর শোনা যায় যেন!
স্বার্থহীন ভালোবাসার আলোয় ভরে যাচ্ছে চতুর্দিক। শৈশবের প্রীতির শুচিস্নগ্ধ আলোয় স্নান করে, বড় প্রীতমনে তিনি এবার অভীষ্টলোকে যাত্রা শুরু করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হয়ে নয়, নন্দলালা কানহাইয়া হয়ে। জগৎপতির জগৎমোহন হাসিটি ধীরে ধীরে এক আনন্দিত শিশুর সরল দুষ্টুমিভরা হাসিতে বদলে গেল।
দোলা সেন||

2 comments:

Anonymous said...

Durdhorsho lekhoni.Anek subho kamona roilo

Anonymous said...

দারুন