||দোলা সেন||
সেই যে ছিল এক রাখাল ছেলে? না গো না, সে মোটেই বাঁশি বাজাতে পারত না। আচ্ছা
সব রাখালকেই বাঁশি বাজাতে জানতে হবে এমন কথা কে বলেছে বাপু?তা বাঁশি বাজাতে না
পারলেও, তার গানের গলাটি ছিল ভারি মধুর। তার বাবার শতেক গরু, হাজার মোষ। রাজার ঘরে
সে দুধ দেয়। সেই রাখাল ছেলে অনেক সঙ্গীসাথী নিয়ে রোজ গরু চরাতে যায়। মাঠে ঘাটে তার
গান শুনে আকাশের পাখি ওড়া ভুলে মাটিতে এসে বসে। বনের হরিণ ঘাস খাওয়া ছেড়ে কান সোজা
করে দাঁড়িয়ে যায়। গরু মোষগুলো চরতে চরতে সব ভুলে শুয়ে বসে রোদ পোহায়।
পেট ভরে না খেলেই দুধ কম হয়। বাপের ব্যবসায়ে টান।
রাজবাড়ির যোগানে কম পড়ে। রাজামশাইয়ের দুধের সরে সোনারঙ ধরে না, রানীর তৈরি
মিঠাইয়ের স্বাদ ফিকে হয়ে যায়। তার ওপর যেদিন রাজপুত্তুর দুধের গেলাস ঠেলে সরিয়ে
দিল, সেদিন বীরু গোয়ালার তলব পড়ল রাজবাড়িতে।
বীরু
জানতই এমন হবে। সে কাঁপতে কাঁপতে রাজসভায় হাজির হলো।
- দোহাই রাজামশাই। আমার কোনো দোষ নাই। সবচেয়ে সরেস মাঠে গরু পাঠাই। আমার ছেলে নিজে চরাতে যায় হুজুর।
কিন্তু গরু আধপেটা থাকে। ঘন আঠালো দুধের বদলে নীলচে পাতলা দুধ দেয়। আপনিই বিচার
করুন মহারাজ।
রাজামশাইয়ের কপালে
ভাঁজ পড়ল। কোতোয়ালকে হুকুম দিলেন চর পাঠিয়ে খবর নিতে।
চর এসে বলে – আবাক কান্ড মহারাজ। এক ছেলে গান গায়। বনের পশুপাখি, মাঠের গরু সব কাজ
ফেলে চুপটি করে সেই গান শোনে। আহাহা, সে যে কি গান মহারাজ!
- কে সেই ছেলে? খবর নিয়েছ?
- কানু, মহারাজ। বীরু গোয়ালার প্রথম পক্ষের ছেলে। মা মারা গেছে অনেকদিন।
সৎমা সকাল হলেই, একথালা পান্তায় জল ঢেলে খেতে দিয়ে, ছেলেটাকে গরু চরাতে পাঠায়। সেই
তো গাছতলায় পা ছড়িয়ে বসে গান গায়।
- এমন গান? তাকে ডেকে পাঠাও।
**** উঁহু, থাক। আমি দেখতেও চাই। কাল ছদ্মবেশে বেরোবো।
তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
পরদিন রাজামশাই এক সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধরলেন। চর হলো তার
চেলা। গ্রামের বাইরে পালকি নামিয়ে বেহারাারা আড়াল হলো। সাধু চললেন পায়ে হেঁটে।
চেলা ভিক্ষা চায় এ বাড়ি ওবাড়ি। আর আড়ে আড়ে দেখে নেয় কোথায় কি হচ্ছে। বলা কী যায়,
কখন কি খবর জোটে। সাধুর কোনদিকে খেয়াল নেই। তিনি নদীর তীরের মন্দিরের দিকে সোজা
চলেছেন। যেতে যেতে যেতে - তাঁর কানে এলো মোহনীয়া সুর। পা আপনি দিক বদল করল। চলতে
চলতে তিনি দেখেন এক অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের তলায় এক কিশোর গান গায়। চুপটি করে
দাঁড়িয়ে রইলেন রাজামশাই। আনন্দে তাঁর দুই
চোখ জলে ভরে এলো। গান শেষ হলে কানু দেখে সাধু। প্রণাম করে হাতজোড় করে দাঁড়ালো।
- আমার প্রণাম নিন প্রভু। কী দিয়ে
আপনার
আপ্যায়ন করব? নদীর মিষ্টি জল, গরুর দুধ আর বনের ফল ছাড়া এখানে তো কিছু নেই।
- আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে না যে? –
সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করেন সাধু।
কানু বিনীত ভাবেই জবাব দেয় – আমার মনে হয়েছিল আপনি হয়তো লোকালয়ে
যেতে পছন্দ করবেন না।
- এমন
মনে হলো কেন তোমার?
- আপনি
পায়ে হেঁটে ঘুরছেন, কিন্তু আপনার পায়ের ধুলোয় বসন ধূসর হয়নি। আপনার আগমনে বনের
পাখি পশু ভয় পেয়ে সরে গেছে। অথচ আপনার চোখদুটি সৎ। আপনি সত্যি সাধু হলে এমনটা হতো
না।
বালকের বুদ্ধি দেখে রাজা অবাক। এমন
ছেলে নাকি গোয়ালার?
- তুমি
চলো আমার সঙ্গে রাজধানীতে। আমার সভাগায়কের কাছে গান শিখবে, রাজগুরুর কাছে পড়াশোনা
করবে।
- কিন্তু
আমার বাবা, আমার গরুমোষের দল?
- তোমার
বাবা আমায় চেনে। সে জানে রাজার কথা মানতে হয়।
তারপর আর কি? কানু গেল রাজার বাড়ি। মানে যেতেই হলো
তাকে। তার নতুন নাম এখন কানন কুমার। সে আর গরু চরায় না, পান্তাভাত খায় না। রাজভোগ
খায়, পাঠশালে যায়, গান শেখে। ভালোই আছে কানন। কিন্তু ঘরের জানালা দিয়ে যেদিন চাঁদ
দেখতে পায়, সেদিন তার ধলী গাইয়ের জন্য, টুনটুনি পাখির জন্য, বনের হরিণটার জন্য
বড্ডো মন কেমন করে। সেদিন সে আবার রাখাল কানু হয়ে বাগানে চলে যায়। সেই যে না শেখা
দিনের গানগুলি – যা তার মনের ভিতরে লুকিয়ে আছে – সেইসব গান গায় প্রাণভরে। রাজার
বাগানের পাখি, ঘোড়াশালের ঘোড়া, হাতিশালের হাতি তালে তালে মাথা দোলায়। তাদেরও কি
চাঁদের মায়ার ঘোর লাগে? কে জানে?
বেশ
চলছিল দিন। কিন্তু এতো সুখ কি সয়? রাজার ছেলে দুধকুমার – ননীর মতো গা, অপরাজিতার
মতো চোখ, রেশম কালো চুল – তার পরণে সোনার সাজ, মাথায় রুপোর তাজ – সেও আসে গুরুর
কাছে গান শিখতে। আগে সেই সেরা ছিল, এখন যেন গুরুর আদর ওই রাখাল ছেলের উপর একটু
বেশি। কানন সবেতে দুধকুমারের চেয়ে এগিয়ে যায়। রাজামশাই সন্ধ্যায় দুধকুমারের সঙ্গে
কাননেরও গান শোনেন।
দুধকুমারের
ননীরঙ গা যেন হিংসেয় সবুজ হয়ে যায়। নীলমণির মতো চোখে রাগের কালো আঁধার ঘনায়। তারপর আসে কোটালপুত্তুর, মন্ত্রীপুত্তুর আর
উজীরপুত্তুরের দল। ফিসফিস শব্দে জাল বোনা হয়, রাজামশাই যেন জানতে না পারে! মারবে
ওরা কাননকে। দূরের পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে ওকে। সেখানেই.....
রাতে
বাগানে গান গায় কানু। বাগানের কাকাতুয়া ডানা ঝাপটায় – পালাও কানু, পালাও। ঘোড়াশালে ঘোড়া পা ঠোকে – কানু চলে যাও
এখান থেকে। গাছের পাতা সিরিসিরিয়ে শিউরে ওঠে – কানু এখানে আর নয়। কানু দেখে
চারিদিক অস্থির। বাতাসে হিম, গা ঝিমঝিম, রাত ছমছম। চারপাশে কেমন যেন অমঙ্গলের
ছায়া। কানু গান শেষ না করেই ঘরে গেল।
পরদিন, দুধকুমার ডাকে – কানন, চলো
পাহাড়ে বেড়াতে যাই।
উজীরের কুমার বলে – ভারি সুন্দর জায়গা।
গেলে ফিরতে মন করবে না।
হাওয়া যেন ভারি হয়ে চেপে বসে। কাননের
যেতে ইচ্ছে করে না। তবু ভাবে, রাজকুমার বলছে যখন...
- রাজামশাইকে
বলতে হবে না?
- বাবাকে
আমি আগেই বলেছি। চলো চলো। বেলা বয়ে যায়। ঘোড়া সাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।
পাঁচজনে
মিলে পাহাড়ে চলল। দুধকুমারের কোমরে তলোয়ার। উজীর কুমারের হাতে ধনুকবাণ।
- অস্ত্র
কেন?
- কি
বোকা তুমি, কানন? বনের জন্তু চড়াও হয় যদি?
- ওদের
মেরো না। ওরা আমার বন্ধু। ওরা কখনও কারো ক্ষতি করে না।
- সে
দেখা যাবে। এমনি এমনি মারবো কেন? এখন চলো দেখি।
পাহাড়ে
উঠছে ছেলের দল। বনপথে কানুর ঘোড়ার পায়ে কাঁটা ফুটে রক্ত ঝরে। নাল নেই কেন? নিচু
হয়ে কাঁটা বের করতে বসল কানু। দুধকুমার বলল – কাঁটা তুলে চটপট এসো। পিছিয়ে পড়লে
হারিয়ে যাবে কিন্তু।
তাড়াতাড়ি
কাঁটা তুলে ফেলে কানু। দাঁড়াতেই বনের ঘোড়া দৌড়ে আসে – কানু কানু, আমার পিঠে চড়
শিগগির। নয়ত তোমার মরণ।
গাছের ওপর টিকটিকি বলে – ঠিক ঠিক।
কানু
দেখে দুধকুমারের হাতে ধনুক! একলাফে সে চড়ে বসল বুনো ঘোড়ার পিঠে। কেশর চেপে ধরল।
নিমেষ ফেলতে হাওয়া হয়ে গেল বনের আড়ালে।
পিছনে
তাড়া করে আসছে চার বন্ধু। রোদ্দুরে তাদের তলোয়ার ঝলকাচ্ছে। ধরে ফেলারই কথা। ঘোড়ার
দল ভান করছে এই ধরলাম, কিন্ত কিছুতেই যেন ধরতে পারছে না। চোখের আড়াল হয়ে গেল বুনো।
প্রাণপণে ছুটছে সে। এসে দাঁড়ালো এক ঘন বনের সামনে।
- আমার
আর ক্ষমতা নেই কানু। এই বনের নাম জাদুবন। কেউ সাহস করে এখানে ঢোকে না। কিন্তু তুমি
সব জীবের বন্ধু। তুমি ভিতরে যাও। বনই তোমায় আশ্রয় দেবে।
- অনেক
ধন্যবাদ অচেনা বন্ধু। ভালো হোক তোমার।
বুনোর দুগালে চুমু খেলো কানু। তারপর বনের মধ্যে ঢুকে পড়লো। পাতায় পাতায় গাছের তলা আঁধার। কানু যত এগোয়.
ঝোপঝাড় সরে পথ তৈরি হয়। কানু এগিয়ে চলে। চলতে চলতে, আর পারে না বুঝি। খিদে,
তেষ্টা, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে। আপেল গাছ ডাল নুইয়ে দেয়, পায়ের কাছে নারকেল ঝরে
পড়ে। ফল, জল খেয়ে সুস্থ হয় কানু। হাঁটু গেড়ে বসে বনের দেবতাকে প্রণাম জানায়। বটগাছের
গায়ে বিরাট ফোকর লতায় পাতায় ঢাকা। কানু তার মধ্যে ঢুকে বসে। পাতারা ঘন হয়ে তাকে
ঢেকে ফেলে। ও মা, দেখতে দেখতে কানু তো ঘুমিয়ে কাদা! দুধকুমারদের কথা ভুলে গেল
বুঝি।
ওরা ভোলে নি কিন্তু। ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন দেখে ওই ওরা এসে পড়েছে জাদুবনের ধারে।
এবার তলোয়ার উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল যে! ঘন ঝোপের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া যেতে পারে না। ঘোড়া
ছেড়ে চার বন্ধু পায়ে হেঁটে এগোলো। এইদিকে ঝোপ হালকা না? তাহলে তো কানু এদিকেই
গেছে! মহা উৎসাহে দুধকুমার এগিয়ে চলে। যাবে কোথায় তাদের হাত এড়িয়ে?
চলতে চলতে নদীর ধার। নদীর পাড়ের কাছে, নৌকা বাঁধা আছে।
তবে কি...
চারজনায় চটপট নৌকায় চড়ে বাঁধন খুলে দেয়। নৌকা একপাক ঘুরে
যেন স্রোতের টানেই ভাসতে ভাসতে একসময় এক চড়ায় আটকে যায়। নেমে বাঁধতে যাবে
কোটালপুত্র – মায়াবনের মায়ানৌকা মুহূর্তে ভেসে চলে যায় কোথায় কে জানে! নির্জন চড়ায়
পড়ে থাকে চারটি মানুষ। মায়ানদী ফুলে ফেঁপে গজরাতে থাকে। এতক্ষণে চমক ভাঙে
দুধকুমারের।
- এটা একটা ফাঁদ। আমরা আটকে পড়েছি।
মন্ত্রীপুত্র
বলে – কানন কোথায় গেল?
নৌকো ধরতে গিয়ে কোটালপুত্র প্রায় জলে ভেসে যাচ্ছিল। সে
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে – কাননের কথা পরে। এখন নিজেরা কি করে ফিরবে তাই ভাব।
অনেক খুঁজল ছেলের দল। নদী পার হবার মতো কিছু পেল না। পেল
কয়েকটা কোদাল, শাবল, বীজ এইসব। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।
******************
*******************
এদিকে কানুর ঘুম ভেঙেছে। সে কোটর থেকে বেরিয়ে দেখে সকাল
হয়ে গেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে আলো এসেছে। লেজঝোলা পাখি কিচিমিচি করে বলে গেল – বিপদ
কেটে গেছে তোমার। ফুটকিওয়ালা হরিণ, কানউঁচু খরগোস, পেখমতোলা ময়ূর সবাই এসে নেচে
গেয়ে বলল – ও কানু, জাদুবন তোমার বিপদ কাটিয়ে দিয়েছে। আনন্দে খুশিতে গান বেজে উঠল
কানুর গলায়। এবারে ওরাই কানুর বাড়ির পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। এতোদিন পরে কানুকে পেয়ে
বাবার খুশি আর ধরে না। সৎমা আড়ে আড়ে চায়। খাবার সময় মাছের মুড়োটি পাতে দেয়। আনন্দে
কানুর চোখে জল আসে। আস্তে করে ডাকে – মা, কাল গরু চরাতে যাবো?
আর সেই দুধকুমার আর তার বন্ধুরা? তারা সেই চরেই থাকে।
এখন আর তাদের রাজপোষাক নেই, তলোয়ার কোথায় হারিয়ে গেছে। তারা সেই জমিতে চাষ করে
সোনা ফলায়। ফসলের রঙরূপে তাদের মনের কালি ধুয়ে যেতে থাকে। তারা কেমনে যেন বুঝতে
পেরেছে, যেদিন তাদের সব মনের কালি ধুয়ে যাবে, সেদিন মায়ানদী আপনি তাদের বাড়ি যাবার
পথ বলে দেবে। তারা অপেক্ষায় আছে।
দোলা
সেন||
2 comments:
এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা । এমন লেখা তার তেমন প্রচার কই গো ঠাকরুন? ফেসবুকে দিলে ও ত পারেন আপনার এই ব্লগ জমিনের কথা, জানত কিছু লোক । নেহাত নিজের একটা লেখা পড়তে ব্লগে এসে দেখি দোলার কলমের কথা আর তারপর গল্পগুলো পড়ছি । জীবনের আর অন্য সব জায়গাতেই এমনটাই হয়ে চলেছে ।
How to make the most of your money with a casino no deposit
How to 스포츠 사이트 make the most of your money with a 먹튀 신고 casino no deposit · Book a casino 먹튀사이트 online and 토토 사이트 추천 register an 메이저벳 account · Make a minimum deposit of US$5,
Post a Comment