পবিত্র
দেবভূমি হৃষিকেশ। গৈরিকবসনা গঙ্গার তীর ধরে একটু এগিয়ে গেলে ডানদিকের বন চিরে যে
পাথুরে পায়ে চলা রাস্তাটা চলে গেছে, তা শেষ হয়েছে একটা ছোট্ট আশ্রমে।
গাছগাছালির আড়াল থাকে বলে বাইরে থেকে চট করে চোখে পড়ে না। কিন্তু একটু এগিয়ে গেলে ফুলে ভরা পরিচ্ছন্ন আশ্রমটি চোখ জুড়িয়ে দেয়। এককোণে অনাড়ম্বর ছোট মন্দির। সেখানে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ পূজিত হন। আসেপাশে দু চারটে কুটির। সেখানে থাকেন স্বামী অভেদানন্দ এবং তাঁর কয়েকজন শিষ্য। সারাদিন কাটে সাধনভজনে। সন্ধ্যায় গঙ্গারতির শেষে অভেদানন্দ এসে মন্দিরের পাশের বেদিকায় বসেন। শিষ্যদের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করেন। এই সময কিছু দর্শনার্থী ভক্তও আসে। অভেদানন্দ তাদের সমস্যা শুনে সাধ্যমতো উপদেশ দেন। নিস্তরঙ্গ সমাহিত জীবনধারা। তাই বুঝি এখানে কিছুক্ষণ চুপটি করে বসলে মন আপনি শান্ত হয়ে যায়।
গাছগাছালির আড়াল থাকে বলে বাইরে থেকে চট করে চোখে পড়ে না। কিন্তু একটু এগিয়ে গেলে ফুলে ভরা পরিচ্ছন্ন আশ্রমটি চোখ জুড়িয়ে দেয়। এককোণে অনাড়ম্বর ছোট মন্দির। সেখানে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ পূজিত হন। আসেপাশে দু চারটে কুটির। সেখানে থাকেন স্বামী অভেদানন্দ এবং তাঁর কয়েকজন শিষ্য। সারাদিন কাটে সাধনভজনে। সন্ধ্যায় গঙ্গারতির শেষে অভেদানন্দ এসে মন্দিরের পাশের বেদিকায় বসেন। শিষ্যদের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করেন। এই সময কিছু দর্শনার্থী ভক্তও আসে। অভেদানন্দ তাদের সমস্যা শুনে সাধ্যমতো উপদেশ দেন। নিস্তরঙ্গ সমাহিত জীবনধারা। তাই বুঝি এখানে কিছুক্ষণ চুপটি করে বসলে মন আপনি শান্ত হয়ে যায়।
সেদিনের
সন্ধ্যাটিও এমনই
শান্ত ছিল। গঙ্গার ঢেউয়ের
মাথায় মাথায় আলোর প্রদীপেরা ভাসছিল। বিশাল দীপাধার নিয়ে আরতি করছিলেন পুরোহিতের
দল। শোনা যাচ্ছিল উদাত্তকণ্ঠের গঙ্গাস্তোত্র। রোজকার মতোই জোড়হাতে দাঁড়িয়েছিলেন
অভেদানন্দ। তবু যেন ঠিক অন্যদিনের মতো নয়। তাঁর একাগ্রতা আজ বারে বারে ব্যাহত
হচ্ছিল। চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল একজোড়া যুবক-যুবতীর দিকে। দর্শনার্থীর ভিড়ে ওরা
যেন একটু আলাদা। নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে আলাপ করছিল, মাঝে মাঝে মৃদু হাসি –
অভেদানন্দের কেমন যেন মনে হচ্ছিল ওদের আলাপের বিষয় তিনি নিজে।
অভেদানন্দ
বহুদিনের সন্ন্যাসী। এসব অনুভূতি ঝেড়ে ফেলার শিক্ষা তাঁর আছে। তিনি ওদের থেকে
দৃষ্টি সরিয়ে স্তবগানে নিবিষ্ট হলেন।
আরতি
সারা হলে আশ্রমে ফিরে এসে অভেদানন্দ বেদিকায় বসলেন। সারাদিনে এটুকু সময়ই নির্দিষ্ট
গৃহী ভক্তদের জন্য। এই সময়েই অস্বস্তিটা আবার ফিরে এল। গঙ্গাতীরের সেই মেয়েটি তাঁর
আশ্রমে ঢুকছে। মেয়েটি সুন্দরী কিনা, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তার চলফেরায় যে একটি
ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ আছে, তা অভেদানন্দ অস্বীকার করতে পারলেন না। মেয়েটি আন্যান্য
ভক্তদের মত এসেই তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলো না। বরং আপন মনে দৃঢ় পায়ে মন্দিরে
এসে প্রণত হলো। ঈশ্বরের স্থান মানুষের ওপরে, ভক্তদের হাজার বার একথা বললেও
এতোদিনের প্রথম প্রণাম প্রাপ্তির ঘরে টান পড়াতে তিনি একটু অনভ্যাসের অস্বস্তি
নিয়েই মেয়েটির দিকে তাকালেন।
বেশ
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি রাধাগোবিন্দের সামনে থেকে উঠল। উপস্থিত দর্শকদের কৌতূহলী
দৃষ্টিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে সহজ পায়েই বেদীর সামনে এসে দাঁড়াল। দু হাত
জড়ো করে সন্ন্যাসীকে নমস্কার করল। অভেদানন্দ অবাক হয়ে দেখছিলেন। কি যেন মনে পড়ি
পড়ি করেও পড়ছে না! তবু স্মিত হেসে নমস্কার ফিরিয়ে দিলেন। জানতে চাইলেন – বলুন, কী
চাই? মেয়েদের প্রতি তাঁর সহজাত মা-ডাকটি এর বেলায় মুখে এলো না। কেন জানিনা
অভেদানন্দের মনে হলো, এই সম্বোধন এই মেয়েকে করা যায় না।
নিজের
শান্ত দুটি চোখ স্বামীজীর চোখে রেখে স্পষ্ট গলাতেই মেয়েটি জবাব দিল – একান্তে কথা
বলতে চাই।
অভেদানন্দ
এই স্পর্ধায় অবাক হলেন। বিরক্তও হলেন কিছুটা। কিন্তু দীর্ঘদিনের সংযমের অভ্যাস তাঁর
মুখ প্রশান্ত রাখল – কিন্তু আমি তো কারো সঙ্গে একান্তে কথা বলি না। সর্বসমক্ষে কথা
বলার অহম্ ছাড়তে না পারলে এই বেদীতলে বসবার অধিকার যে পাওয়া যায় না মা।
মা
শব্দটায় একটু বেশি জোর পড়াটা মেয়েটির কান এড়ালো না। একগাল হাসল এবার –
-
আমি কিন্তু আমার জন্য বলিনি। আপনার কথা
ভেবেই.....
সামান্য
বিরতির পরে মুখ খুলল –
-
আমার
নাম নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি বাঁকুড়ার রঘুনাথপুর থেকে আসছি।
অভেদানন্দ
স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর স্মৃতি খুবই প্রখর। তাই চিনতে কোন অসুবিধা হলো না। আসলে
চেহারাটা তো ভালো করে দেখেনই কখনো। তাই প্রথমটায় চিনতে পারেননি।
একসময়
রঘুনাথপুরে থাকতো পুষ্পেন মুখোপাধ্যায়। ছোট থেকেই যে কোনো বাঁধন তার অসহ্য লাগতো।
সেটা স্নেহেরই হোক কিম্বা শাসনের। তাই বারবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতো। ধরাও পড়ত
কিছু দিন বা কিছু মাস পরে। এ অবস্থায় সাধারণ বাবা-মা যা করে থাকেন, এক্ষেত্রে
তাঁরাও তাই করলেন। ব্যানার্জীদের লক্ষীমন্ত সুন্দরী কিশোরীটির সঙ্গে ছেলের বিয়ে
দিয়ে দিলেন। বিয়ের আসরে অত্যন্ত বিমুখ মন নিয়ে আচারগুলো পালন করেছিল পুষ্পেন।
মায়ের আত্মহত্যার হুমকি বোধহয় তাকে একটু নরম করে এনেছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান যতো
এগিয়েছে, ততোই পুষ্পেনের মনে হয়েছে তার চারপাশের বাঁধন আরও শক্ত হলো বুঝি। সে ভালো করে মেয়েটির মুখের দিকে চেয়েও দেখেনি।
সবশেষে বৌভাতের পর ফুলশয্যার বাসরে আর পারলো না। মেয়েটিকে তার অক্ষমতার কথা কোনমতে
জানিয়ে সে রাতেই ঘর ছেড়েছিল।
অশান্ত
মনে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একসময় হৃষিকেশে এসে পৌঁছায় পুষ্পেন। সেখানে স্বামী
অসীমানন্দকে দেখে এই এতোদিনে তার মনে হয়, শান্তির খোঁজ এখানেই পাওয়া যেতে পারে।
অসীমানন্দ তাকে ফেরাননি। শিষ্য করে নিয়েছিলেন। দীক্ষান্তে তার নাম হয় অভেদানন্দ।
পুরোনো নামের সঙ্গে পুরোনো স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে ঈশ্বরসাধনাতে তিনি শান্তি খুঁজে
পেয়েছিলেন।
এতোদিন
পরে আজ কেন এসেছে এই নারী? কেঁদেকেটে তাঁকে সংসারে ফেরাতে? ভ্রু কুঞ্চিত হলো
সন্ন্যাসীর। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন –
কী
চাই আপনার?
মা-ডাক
এড়িয়ে যাওয়াটা নজর এড়ালো না। হাসি ফুটে ওঠা মুখেই জবাব দিল –
-
একটা
সই। না, ঠিক আপনার নয়। পুষ্পেন মুখোপাধ্যায়ের। আসলে ওই সইটা না পেলে ঐ একদিনের
ঘটনা থেকে আমি মুক্তি পাচ্ছি না যে! আপনাকে ত্যাগ না করতে পারলে আমি নিজের আকাশে
উড়ি কি করে, বলুন?
কথা
বলতে বলতেই ব্যাগ হাটকে একগোছা কাগজ বার করে এগিয়ে দেয়। সঙ্গে একটা কলমও।
অভেদানন্দ
একবার ওই স্ট্যাম্পপেপার দেখেন, আরেকবার মেয়েটির মুখ। নাহ্, নন্দিতার মুখে কোন
কষ্ট বা জ্বালার চিহ্নমাত্র নেই। বরং খাঁচার দরজা খুলতে দেখলে পাখির আনন্দ আর আলো
মাখানো মুখ একখানা। অভেদানন্দ নীরবে হাত বাড়িয়ে কলমটা নিয়ে সই করে দিলেন। নন্দিতা
হাসিমুখে নমস্কার করে বেরিয়ে যাবার পরে মনে পড়ল – কলমটা তো ফেরত দেওয়া হলো না!
দর্শনার্থীরা
কি বুঝল কে জানে! তারা চুপচাপ আশ্রম ছেড়ে চলে গেল। অভেদানন্দ একলা বেদিকায় বসে
রইলেন। এতোদিন সবাই তাঁকে কাছে পেতে চেয়েছে, ধরে রাখতে চেয়েছে। আর তিনি বার বার নিতান্ত
অবহেলায় তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাদের আকুল হয়ে পথ চেয়ে বসে থাকাটা যতো ভেবেছেন,
পালানোর ইচ্ছে ততো প্রবল হয়েছে।
আজ এই প্রথম কেউ তাঁকে অবহেলায় ত্যাগ করে চলে
গেল!
কলমটার
দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন সন্ন্যাসী। তাঁর গালদুটো জ্বালা করছে ভীষণ। আরও কিছু
জ্বলছে কি? মন্দিরের শয়নারতির প্রার্থনা ছাপিয়ে আজ তাঁর কানে গ্রামের হরিদাসী
বৈষ্ণবীর গান ভেসে আসে – বনমালী, তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা...
4 comments:
ভাষা এবং বর্ণনা সুন্দর। কিন্তু সাধারণ মানুষের যা হয় যিনি পূর্বাশ্রম ত্যাগ করেছেন এবং নির্বিকল্প স্তরে আছেন তাঁর এই বৈকল্য হবার কথা নয়। পরস্পরের সই হলেও বিবাহ ভঙ্গ হয় না, সেই জন্য আদালতে বিচারকের কাছে যেতেই হয়। মনে হয় না অভেদানন্দ সেই পথে আবার যেতে চাইবেন। বারো বৎসর নিরুদ্দেশ থাকলে বিবাহ এমনিতেই ভঙ্গ হয়ে যায় কিন্তু কাগজে সই করে দিলে তিনি ার নিরুদ্দেশ থাকেন না। তখন তাকে আদালত প্রাঙ্গনে আসতেই হবে।
এক্ষেত্রে বারো বছর হয়নি। তাহলে মেয়েটি যুবতী কাতো না। সন্ন্যাস নিলেই কি সবাই নির্বিকল্প হতে পারেন? অভেদানন্দের সই না করার উপায় ছিল না। না করলে ভক্ত বৃন্দ এবং শিষ্যদের সামনে তিনি অনেক ছোট হয়ে যেতেন। এই মোহ যে তাঁর আছে সেটা গল্পের ছত্রে ছত্রে বলা হয়েছে।
আরেকবার পড়ে দেখবেন প্লিজ? আপনার মতামত আমার কাছে খুব দামী।
শুভেচ্ছা জানাই।
আমার মনে হয়েছে যে দু'জনের বয়েসের ফারাক অনেকটা, গল্পে কিন্তু সেই ইঙ্গিত আছে। সেটা বুঝতে পারি নি মেনে নিলেও সই দেয়ার পর যখন আদালতে যেতে হত তখন তো সবার সামনে ব্যাপারটা আসতোই । তবে বিরজা হোমে নিজ আত্মপরিচয় বিসর্জন দেবার পর বারো বৎসর নির্জনে সাধনায় কিছুটা প্রাথমিকতায় ফিরে এলে তবেই গুরুর অনুমতিতে সন্নাসী হওয়া যায়। এইটাই সনাতন ধর্মের নিয়ম, এখন যারা হুট হাট গেরুয়া পরে নেন তাঁরা আমাদের ধর্মের এই অনুশাসন মানছেন না।
অভেদানন্দ সেই উচ্চতায় উঠেছে বলে আপনার মনে হয়ে থাকলে সেটা বোধহয় এই লেখকের দুর্বলতা।
Post a Comment