Tuesday, March 26, 2019

খেলা ভাঙার খেলা


কাল : ১৯৬৮
প্রশ্ন: আজকে কোথায় দাঁড়িয়ে
*
*
*
দেবজিৎ,

সম্বোধনটায় অবাক হলে? নাম ভাঙা তো আমার চিরকালের প্রিয় খেলা, তাই সবটুকু জুড়ে ডাকিনি কখনো তোমায়। জিৎ, দেব, জীঈঈ, দেবা. দেবুচন্দর --- ইত্যকার ডাকেই তুমি ঠিক ঠিক বুঝে যেতে আমি কেমন মুডে আছি। হয়ত ভাবছ, তাহলে আজ কেন............


আসলে দেবজিৎ আজ আমি অনেক বড় কিছু ভাঙতে বসেছি। তাই আজ তোমার নামটুকু অন্তত জুড়ে দিলাম। কিছু তো থাক অখণ্ড – তোমার আমার মাঝখানটিতে!
আমি তোমায় ভুলতে চাইছি দেবজিৎ - আমার সমগ্র সত্ত্বা থেকে তোমায় কেটে কেটে বাদ দিতে চাই একটু একটু করে। কাটতে গিয়ে নিজেকে টুকরো টুকরো করছি প্রতি মুহূর্তে, আবার প্রবল প্রচেষ্টায় তাকে জুড়ছি – হয়ত ঠিক হচ্ছে না জোড়া – অষ্টাবক্র মুনির মত বেঁকেচূরে যাচ্ছি - তবু অষ্টাবক্র মুনিও তো বেঁচে ছিল, বল? আমিও বাঁচব – হেঁটে, চলে, কথা বলে! এই বা কম কিসে?

তিন মাস পাঁচদিন – তোমার সাথে দেখা করিনি আমি। কথাও বলিনি। পেরেছি তো! বেঁচে আছি তো এরও পরে! বাকি জীবনটাও বাঁচব ঠিক – দেখে নিও।

ছমাস আগের এক ভোরে কোন নোটিশ ছাড়াই বাবা যখন হঠাৎ ছবি হয়ে গেলেন, তখন পড়ে রইলাম আমি,মা আর দিদিভাই। তুমি তো জান দেবজিৎ, আমাদের সাহায্য করার মত কোন আত্মীয় নেই। এক কাকা ছিলেন, তা তিনিও তো.....। তবে বাবার কোম্পানিটা খুব ভাল। ওরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে ,জান? ওদের ওখানে একটা চাকরির অফারও দিয়েছে। মাকে বেছে নিতে হবে, দুবোনের মধ্যে কাকে তিনি এই সুযোগ দেবেন।

মা তিনদিন খায় নি, কারো সাথে একটি কথাও বলেনি। চারদিনের দিন এই পাঁচটা বাক্য বলল শুধু –

১) দিদি গ্র্যাজুয়েট নয় এবং ঘরোয়া
২) আমি গ্র্যাজুয়েট এবং স্মার্ট
৩) আমি চাকরি করলে ডিগ্রীর জোরে বেশী মাইনে পাব, কিন্তু পড়াটা বন্ধ হয়ে যাবে
৪) দিদি সুন্দরী বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া যাবে
৫) এবার দুবোনে জানাও তোমরা কি করতে চাও।।।।।।

আমার কিছু করার নেই দেবজিৎ। সংসার চালাতে হলে মার যুক্তি খণ্ডনের কোন পথ আমার সামনে খোলা ছিল না। তাই এম. এ ক্লাসের বেঞ্চে আমাকে আর খুঁজো না তুমি।
মার কথা মিলে গেল। দিদির একটা সম্বন্ধের কথা আগে থেকেই চলছিল। আমিই যোগাযোগ করলাম। কথাও পাকা হয়ে গেছে। ষাণ্মাসিকেই বাবার বাৎসরিকটা সেরে নেব। অফিস থেকে লোন নিয়ে ওর বিয়েটা সেরে ফেলব তারপরেই। বাবার শোকটাই মূলধন। অফিস আর আত্মীয়দের সাহায্য পেতে হলে এটুকু তাড়াতাড়ি তো করতেই হতো, তাই না? অভাবের সংসারে শোকের অবকাশ বা নির্জনতা কোনটাই মেলে না এ আমি হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি দেব।
কাকার চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাবার অ্যাকাউন্ট শূন্যপ্রায়। তবু তিনিও যদি বেঁচে থাকতেন! হয়ত কাকার মৃত্যুটাই বাবার মৃত্যুও ত্বরাণ্বিত করল! মায়ের তো আমি ছাড়া আর কেউ রইল না – সবদিক থেকেই। তাই এটাই আমার সংসার; আমার ভবিষ্যৎ। আমার মায়ের তো আর তোমার বাড়ীতে জায়গা হবে না! হলেও সে বড় অসম্মানের হবে। মেয়ে হয়ে মাকে সেখানে ঠেলি কি করে বলোতো?

তাই তোমাকেই বাদ দিলাম দেবজিৎ। হয়ত নিজেকেও। এই তিনমাস পাঁচদিন ধরে তোমাকেই ভোলার চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। ভুলছিও। এখন আর সেভাবে তোমাকে মনে পড়ে না।

শুধু যেদিন ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে যায়, সেদিন কলেজ এস্কারশনের এক শিউলিমাখা ভোরের ফুল কুড়োনোর কথা মনে পড়ে। সেদিন বাড়ী ফিরবার সময় আচমকা বৃষ্টিতে যখন জল জমেছে,তখন মিত্রদের গাড়ীবারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। তখন, ঠিক তখনই - সেই ক্যাটকেটে নীল রঙের ছাতা মাথায় গান গাইতে গাইতে তোমার আছাড় খাবার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আবার সন্ধ্যেবেলায় চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে......

না দেবজিৎ, - তাই ঠিক করেছি অলস  মুহূর্তগুলো ছেঁটে ফেলব জীবন থেকে। আগামীকাল থেকে একটা টিউশন শুরু করছি।

ভাল থেক দেবজিৎ। আমার জন্য অপেক্ষা করো না। আমি তোমার প্রতীক্ষায় নেই – থাকতে পারি না। ভালবাসা নেই ভাল বাসা? তাও নয়। তবু বেঁচে থাকা---

ইতি
অর্পিতা

No comments: