ভীষণ বিরক্তিতে
চায়ের কাপটা ঠক করে নামিয়ে রাখলেন অনুপমা। খবরের কাগজটাকে ছুঁড়ে ফেললেন পাশের
টেবিলটায়। রাগের চোটেই বোধহয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন, কাগজটা আধখোলা অবস্থায় ছড়িয়ে পড়ে
রইল মেঝেতে। দেখে বিরক্তিটা আরো বাড়ল অনুপমার। ছড়ানো ছেটানো অগোছালো চারপাশ
একেবারে বরদাস্ত হয় না তাঁর।বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলেন নিজের মনেই, ‘কোন মানে হয় না।‘
আসলে আজকাল অধিকাংশ জিনিসেরই মানে বোঝেন না
অনুপমা। এই যেমন গত দু- তিনদিন যাবৎ কাগজ খুললেই পাঁচশ হাজারির গল্প। তা এদের বাতিল
হবার গল্পে বিশেষ কিছু এসে যায় না তাঁর। সামান্য যা কিছু ছিল ঘরে, ছেলে ব্যাংকে
জমা দিয়ে দিয়েছে। চিরকালের গোছানো মানুষ তিনি। তাই খুচরো যা কিছু ছিল ঘরে, হিসেব
করে চললে তাদের পাঁচজনের সংসার হেসেখেলে পার করে দেবে কয়েকদিন। সমস্যাটা অন্য
জায়গায়।
গতকাল ফলওয়ালাটা ঘ্যানঘ্যান করছিল বড্ড। এমনিতে
ফল কেনার বাতিক আছে তাঁর। একদিন পরপরই বেশ কিছু ফল কেনেন তিনি।কিন্তু এখন এসব
বিলাসিতার সময় নয়। ছেলে বৌ সকাল আটটায় বের হয়ে রাত নটায় ফেরে। কর্তার পায়ে বাত,
খুচরোর জন্য লাইন দেবে কে? সেকথা বলেই বিদায় করেছেন রামুকে। কিন্তু মুখটি চুণ করে
রামু যা বলে গেল, সেটাই কাল থেকে মাথায় বাসা বেঁধে আছে। রামু তার ফলের ঝুড়িটা
নামিয়ে রেখে রোজের বরাদ্দ জল-বাতাসা খেয়ে ধীরে ধীরে বলেছিল,
- ‘কেউ ফল নিতে চাইছে না
মা গো। এই রোজের পয়সাটা ঘরে না নিয়ে গেলে নিজেরাই বা খাব কী, আর ছেলেমেয়েকেই বা
খাওয়াব কী’।
- “সে কি রে, ব্যাংকে কিছু জমা
নেই?সেখান থেকে কিছু তুলে,,,,”
রামুর মলিন হাসিটা তাঁর কথা বন্ধ করে দিয়েছিল।
- ‘কি
যে বল মা, ব্যাংকে আর কি জমাব? রোজ ফল তুলে বিক্রি করি, যে পয়সা পাই, তার কিছুটা
দিয়ে নতুন ফল কিনি, বাকিটা দিয়ে রোজের বাজার দোকান, ছেলেমেয়ের বইখাতা, টিউশনি –
জমাবার মত পয়সা কোথায় পাই? তবে তোমাদের আশীর্বাদে মোটামুটি দিন কেটে যায় মা।
কিন্তু এখন বেশীর ভাগ লোক ফল কিনছে না, তাই,,,,,’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফলের
ঝাঁকাটা তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল রামু, লক্ষ্য না করে পারেন নি অনুপমা – রামুর ফলের
ঝুড়িতে আজ ফলের সংখ্যা অনেক কম।
তারপর আজ।
খবরে দেখলেন অনুপমা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো বেশ কিছুদিন লাগবে। রামুর
কথা ভেবে একটা শ্বাসের সাথে বেরিয়ে এল – ‘কোন মানে হয়’! ব্যস, এর জেরেই পুত্র ও
পুত্রবধুর কাছ থেকে প্রভূত জ্ঞান শুনলেন। বুঝলেন, মানে বুঝতে বাধ্য হলেনই বলা যায়
যে, এই দীর্ঘশ্বাসের
অর্থ দেশদ্রোহিতা। বোঝাতে পারলেন না অন্য মত মানেই বিদ্রোহ নয়, ভিন্ন মতধারীকে
বিদ্রূপ তো নয়ই।
তার উপর তিন
নম্বর পাতায় একটা খবর বেরিয়েছে আজ। কোন এক কিশোরী কারো প্রেম প্রস্তাব
প্রত্যাখ্যান করায় সেই ব্যক্তিটি মেয়েটির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছে। মত না মেলার
শাস্তি! এত অসহিষ্ণুতা! দুটি সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ, তাদের ভিন্নমত থাকতেই পারে ।
কিন্তু এই জোর করে একীকরণের চেষ্টা – আবারও মাথা নাড়েন অনুপমা, - ‘ কোন মানে হয়
না’।
যাকগে। আপাতত
কাগজটা গুছিয়ে রেখে সংসারের কাজে মন দিলেন অনুপমা। এইসব করতে করতেই নাতির আসার
সময় হয়ে এল।বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন পিঠে ব্যাগ নিয়ে তরতরিয়ে
আসছে তাতুন। আজ কিন্তু সে অন্যদিনের মত এসেই জড়িয়ে ধরল না ঠামমনিকে। রাগ-গনগনে
মুখে ঝামরে উঠল –‘ এই স্কুলটা বিচ্ছিরি। কেন এই স্কুলে ভর্তি করেছ আমায়’?
‘কি হল রে’ -
মাথায় হত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টাটা নস্যাৎ করে হিসহিসিয়ে উঠল ছেলে , ‘ জান আজ
স্কুলে জল খেতে চেয়েছি বলে মিস বকা তো দিলই, কাল আবার গার্জেন কলও করেছে। পড়তে চাই
না আমি অমন স্কুলে’।
পিছন থেকে দাদুর
গলা গমগমিয়ে উঠল – ‘ ঠিকই তো দাদুসোনা, দরকার নেই অমন স্কুলে পড়ার। কাল দেখা করে
একদম টিসি নিয়ে আসব। এখন ঘরে চল দেখি’। একটু কি শান্ত হল তাতুন? মৃদু হেসে খাবার
সাজাতে থাকেন অনুপমা। মনের মধ্যে একটা খচখচানি থেকেই গেল কিন্তু।
খাওয়া দাওয়ার পর
দুপুরে দাদুর গলা জড়িয়ে যখন শুল তাতুন, তখন বোঝা গেল ব্যাপারটা। ক্লাসে মিস যখন
কথা বলছিলেন একটি ছেলের সাথে, তাতুন তখন জল খাবার অনুমতি চায়।ইশারায় তাকে থামিয়ে
মিস কথা বলছিলেন যখন, তখন আবারো জলের কথা বলে তাতুন। তাতেই বকুনি খেয়েছে সে,
অপেক্ষা না করার জন্য।
‘বল দাদু, একটা ইয়েস বলত়ে কত সময় লাগে? আমি তিনবার জিজ্ঞাসা করেছি জান’!
‘ঠিকই তো দাদুসোনা, বলতো মিস কটা কথা বলেছিলেন ওই ছেলেটির সাথে? গুনেছো তো?
কাল স্কুলে গিয়ে বলতে হবে তো?’ দাদুব় এহেন প্রশ্রয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে তাতুন –
‘গুনেছিই তো?চার চারটে সেন্টেন্স! আর আমাকে ইয়েস বলল না’!
‘হুঁ, তা সোনাভাই, চারটে সেন্টেন্স বলতে তো পাঁচ সেকেণ্ডের চেয়ে বেশী সময় লাগে
না’ – দাদুর গলা এবার ঈষৎ কঠিন – ‘ এটুকু সময় অপেক্ষা করতে পারলে না? অথচ তারপর
পাঁচমিনিট তর্ক করতে তো পারলে? বড়দের কথার মাঝখানে কথা বলতে নেই এ তো তুমি জান
সোনাভাই, তাহলে?'
এইবার তাতুনের চোখ বড় বড়, মাথা নীচু, আর ওই বড় বড় চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে কয়েকফোঁটা
পবিত্র বিন্দু। ‘সরি দাদু, সরি ঠামমনি, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর একটু অপেক্ষা করা
উচিত ছিল আমার’। দুহাতে সে জডিয়ে ধরে তার ঠামমনিকে।
আর এতক্ষণে অনুপমার মনের ভিতর শিউলি ঝরে পড়ে টুপটাপ। তাতুনকে বুকে জড়িয়ে ধরে
তিনি মনে মনে বলেন, -“তাতুন, এই দুনিয়ায় আর একটু সহন নিয়ে আয় - সবাই যাতে তার নিজের
মতো থাকতে পারে – একটু অপেক্ষা, একটু ধৈর্য – না হলে এই সবুজ পৃথিবীটারই কোন মানে
হয় না যে”।
No comments:
Post a Comment