‘নীলা, তুইকি
জানিস যে সুস্মিত - দ্য ডিবেটার তোকে খুব পছন্দ করে ?’
নীলা তখন খুব মন
দিয়ে একটা প্রজাপতির ছবি তোলার চেষ্টা করছে। মিলির দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবরটা তাই
হাওয়ায় ভেসে যায়। একটু বিরক্তই হয় মিলি। নীলাটা চিরকাল একইরকম রয়ে গেল! এবার তাই
প্রিয়বান্ধবীকে ধরে ঝাঁকিয়েই দেয় – ‘কি রে, কী বললাম, কানে গেল?’
নীলার ছবি তোলা
শেষ ততক্ষণে। একগাল হেসে বলল,- ‘বিলক্ষণ, চল তাহলে দেখে আসি।’
‘দেখে আসবি ? কি
দেখবি .... আর কোথায়....’
‘আরে,
ঘাবড়াচ্ছিস কেন, তোর সুমিতবাবুকে দেখে আসতে হবে না? ’
‘সু – মি- ত? তার
মানে এতক্ষণ তুই কিচ্ছু শুনিস নি!’ রাগের চোটে দুপদাপিয়ে চলে যায় মিলি। আর এবার
সত্যিই বিপাকে পড়ে নীলা। কলেজে ঢোকা ইস্তক এই মেয়েটির সাথেই তার গলাগলি
বন্ধুত্ব। চঞ্চল সৃষ্টিছাড়া স্বভাবের জন্য এমনিতেই তার বন্ধু নেই বিশেষ। এখন সেও
যদি ক্ষেপে যায় !
যাকগে,ওই সুমিত
নাকি অমিত(?) নামের ছেলেটি নির্ঘাৎ কলেজেই পড়ে। মিলির পরিচিতির
দৌড় জানে বলেই এ বিষয়ে অন্তত নিশ্চিত নীলা। কাল দেখে নিলেই
হবে কোন শ্রীমান.... ।
পরদিন। কলেজ থেকে
ফিরবার পথে নীলার চোখ আটকে গেল মাটির দিকে – তার পায়ের ঠিক পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে
লাল-কাল ডোরায় রাঙা একটা শুঁয়োপোকা,
চোখদুটি কি উজ্জ্বল সবুজ! চোখ? নাকি camouflaged adaptation? কলেজের মাঠটায় বসে পড়ে খুব
অভিনিবেশ সহকারে দেখতে থাকে নীলা। নীলা এরকমই। একটা প্রজাপতি, একটা নীল আকাশ, একটা
কবিতা বা গল্প – এইসব নিয়ে তার জগৎটা বেশ ভরপুর।
শুঁয়োপোকা দেখা শেষ করে উঠতে যাবে, দেখে ঝকঝকে চেহারার একটি ছেলে সামনে
দাঁড়িয়ে হাসছে। একটু চেনা চেনা লাগল নীলার। নবীনবরণের সময় এই ছেলেটাই না খুব
সুন্দর ভাষণ দিয়েছিল? কি যেন নাম কি যেন---- এই সব ভাবনার মাঝেই হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে ছেলেটি – ‘আমি মিলির বন্ধু। ওর কাছে বোধহয়..’ কথার মাঝে কথা কাটতে নীলার জুড়ি পাওয়া ভার।
তড়বড়িয়ে বলে ওঠে- ‘আপনিই অমিত? মিলির কাছে আপনার নাম শুনেছি অনেক।’ দৃশ্যতই
একটু থতমত খায় “অমিত”, তবে দ্রুত সামলে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ আমি অমিত, আমার নাম আপনি
অনেক শুনেছেন, সেটা স্বীকার করতেই হবে।’
প্রথম দর্শনের ফলটা খুব একটা ভাল হল না। একটা রোম্যান্টিক কাহিনীর এহেন
পরিণতিতে বেজায় চটে গেল মিলি। ‘তোর দ্বারা কিস্যু হবে না’ জাতীয় কথা পর্যন্ত
গড়িয়ে গেল ছেলেমানুষী ঝগড়াটা।
কিছুদিন কেটে গেছে। কলেজে ডিবেট কম্পিটিশন। নীলা দেখে তার বিপরীতে সেই অমিত –
না না, ওই তো নাম ঘোষণা করল সুস্মিত রায়! ডিবেটটা নীলা ভালই করে, তার উপর মিলির
সাথে ঝগড়ার জন্য তার যাবতীয় রাগ যখন তর্কের যুক্তির ডগায় বিদ্রূপের ঝাঁঝে ঝাঁঝিয়ে
উঠল, তখন সুস্মিতকে সে কোথাও দাঁড়াবার জায়গা দিল না। প্রথম পুরস্কারটা হাতে নিয়ে
সে যখন স্টেজ থেকে নামছে, তখন তাকে সবার আগে জড়িয়ে ধরল মিলি।
সুস্মিতও তাকে এসে অভিনন্দন জানাল। এভাবেই নানা কম্পিটিশন, কফির টেবিল, নাটকের
মঞ্চের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ জমে ওঠে। খুব নরম আর ভাল ছেলে সুস্মিত, এতটাই ভাল যে
নীলার কেমন যেন অস্বস্তি হয় মাঝে মাঝে। নীলার প্রতি ওর একান্ত বাধ্যতা, প্রায় সময়েই
যা আনুগত্যেরই রূপান্তর – খুশী হবারই কথা নীলার, অখুশীও ঠিক নয়, - তবে ওই একটা
‘কেমন যেন’ এর হাত এড়াতে পারে না সে কিছুতেই।
কলেজ পার করে ইউনিভার্সিটি। আলাপ ততদিনে প্রতিশ্রুতি। একদিন সুস্মিত বলে, ’চল,
তোমায় মায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিই। মাম তোমায় দেখতে চেয়েছে।।’ একটু লজ্জা- সংকোচ
মেশান নতুন অনুভূতি নিয়ে সুস্মিতের বাড়ী গেল নীলা। সুস্মিতের মাম আরাত্রিকা দেবী
দারুণ সুন্দরী এবং আধুনিকা। ছেলের বান্ধবীকে খুবই সহজ আপ্যায়ন করলেন তিনি। কেক
মিষ্টি খাওয়ালেন, অনেক গল্প করলেন, আবার আসার নিমন্ত্রণও দিলেন। সবই ভাল, তবু
বাইরে এসে একটা খুব বড় করে শ্বাস নিল নীলা। সহজ কথা, সহজ বাড়ীর গল্প, তবু নীলার
যেন মনে হচ্ছিল স্ক্যানারের তলায় ফেলে তাকে ছানবিন করা হচ্ছে ! সুস্মিতকে বলতে সে
হেসেই উড়িয়ে দিল।
এরপরেও আরাত্রিকার ডাকে অনেকবার সুস্মিতদের বাড়ী গিয়েছে নীলা। নানা ধরণের বই
যোগাড় করে রাখতেন তিনি। একসাথে বসে আসন্ন পরীক্ষার নোটস তৈরি করত ওরা, আরাত্রিকা
যোগাতেন কফি, স্ন্যাক্স। কখনো সখনো লাঞ্চও। সুন্দর সহজভাবে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল
দিন। দুজনেই খুব ভালভাবে পাশ করার পরে একটা পার্টিও দিয়ে ফেললেন আরাত্রিকা।
সেখানেই ঘোষণা করলেন উচ্চশিক্ষার্থে ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন তিনি। খুব খুশী হয়েছিল
নীলা। রেজাল্ট বেশী ভাল হলেও তার মধ্যবিত্ত পিতার পক্ষে তাকে বিদেশ পাঠান সম্ভব
ছিল না। সুস্মিতের খবরটা তাই তার কাছে একটা খুশীর হাওয়ার মত লেগেছিল।
বছর তিনেক পর। নীলা এখন এক কলেজের অধ্যাপিকা। সুস্মিত ফিরে এসেছে , পকেটে তার
বিদেশী ডিগ্রী আর এক নামী কোম্পানীর মোটা মাইনের চাকরি। সুখী কল্পনার জাল বোনে
দুজনে, ভাবে বিয়েটা এবার করে ফেলতে হবে। কিন্তু সুস্মিত কেবলি বলে, ‘মাম বলেছে
কদিন পরে,’ কিংবা ‘মাম বলছে এখন একটু অসুবিধা আছে’.....। নীলাকে আর বাড়ীতে
আমন্ত্রণ জানায় না সুস্মিত, বিয়ের কথা হবার পর থেকে নীলারও একটু লজ্জাই করে ওবাড়ী
যেতে। এভাবে কিছুদিন চলার পরে সুস্মিত একদিন জানাল, ‘মাম বলেছে সামনের
অঘ্রাণে...’।
নীলার বাবা মা মনখুলে আশীর্বাদ করেন দুজনকে। দিন ঠিক করার জন্য আরাত্রিকার
আমন্ত্রণে একদিন গেলেন ওবাড়ী। আরাত্রিকার মধুর আপ্যায়নে মুগ্ধ হলেন । এবার বিয়ের
কথা। আরাত্রিকা একই রকম মধুর হেসে বললেন, ‘তা কি করে হয়, দুবাড়ীর স্ট্যাটাসের
তফাৎটা বড্ড বেশী। নীলা আমার ছেলের বান্ধবী, এ ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। ছেলের
বন্ধু বিচারে আমি ইন্টারফিয়ার করিনা, তা বলে বৌ বিচারে’.....
‘তাহলে ওদের এভাবে মিশতে দিলেন কেন?’ নীলার মায়ের প্রশ্নের জবাবে তেমনই মধুর
আর শান্তভাবে বোঝান আরাাত্রিকা, - ‘ওরা একসাথে পড়াশোনা করত। আমিই তো কিনে এনে
দিয়েছি রেফারেন্স বইগুলো। বরং রেজাল্টের জন্য তো আমার কাছে আপনাদের মেয়ের তো
কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, তাই না? আর তাছাড়া মিতুর সব বান্ধবীর সাথেই যদি আমায় ছেলের বিয়ে দিতে হয়, তাহলে...’
এর উপর আর কথা বাড়ানো চলে না, বাড়ানও নি ওঁরা।
পরদিন। শুধু স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছে নীলা – সুস্মিতের মুখোমুখি – তাদের বহুচেনা
কফির টেবিলে। একসময় সেই স্তব্ধতার ভার অসহ্য হওয়ায় সুস্মিত আমতা আমতা করে, ‘মাম চাইছে
না এ বিয়েটা হোক। আমি জানতাম না মাম তোমাদের বাড়ীতে ডেকে এভাবে বলবে। প্লীস নীল,
এই ছোট্ট ঘটনাটা ভুলে যাও। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। কিছু সময় দাও আমায়, আমি
ঠিক মামকে বুঝিয়ে...’।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় নীলা। এককাপ কফির দাম টেবিলে নামিয়ে রেখে একটিও কথা না
বলেই বার হয়ে আসে। তার শুধু মনে পড়ছিল, তাদের প্রথম আলাপের দিনের সেই সুন্দর
শুঁয়োপোকাটিকে – যার বর্ণবৈচিত্র্যে সে মুগ্ধ হয়েছিল। শুয়োপোকাদের যে মেরুদণ্ড
থাকে না, সেটাই শুধু সে মনে রাখতে পারে নি। আকাশের দিকে তাকায় একবার। অনেক মেঘ
জমেছে সেখানে। কিন্তু মেঘ কেটে যাবে জানে নীলা – আজ হোক, কাল হোক, কাটবেই। আজ যতই
মেঘ গজরাক, যতই বাজুক বিশেষ চেনা রিংটোন, পার হয়ে যাবে সে – যাবেই একদিন॥
2 comments:
মুগ্ধ হলাম
এটা উপন্যাস হলে ভালো হতো। খুব সুন্দর।
Post a Comment