অহল্যা দ্রৌপদী
কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা
স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম॥
*
পঞ্চকন্যার পঞ্চমার নাম মন্দোদরী। এই কন্যাটির জন্য সপ্তকাণ্ড রামায়ণে
বেশি শব্দ ব্যয় করেননি মহাকবি বাল্মিকী। কিন্তু ব্যক্তিত্বের হীরকদ্যুতির প্রভায়
তাঁর এই স্বল্প উপস্থিতিও মনের চোরাকুঠুরিটা আলোয় আলোময় করে তোলে। যত অল্প জায়গা
জুড়েই থাকুন না কেন, রামায়ণ পড়লে এই নামটি মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে – আরও হাজার
একটা চরিত্রকে পিছনে ফেলে।
শুরুটা অনেক আগে থেকে। এক মেয়ে কৈলাসে
এসেছিল শিবের পুজো করতে। তার সৌন্দর্যে কামমোহিত হলেন আশুতোষ। সেই মেয়ে অপ্সরা
মধুরা। দেবতাদের তুষ্টিসাধনই তার কাজ। আর আজকের আহ্বানকর্তা তো স্বয়ং দেবাদিদেব।
আত্মনিবেদন শেষে ফিরে যাচ্ছিল মধুরা। গোল বাধলো অন্য জায়গায়। পার্বতী বাড়ি ছিলেন না। তিনি এই সময়েই ফিরলেন।
রমনতৃপ্ত স্বামীর মুখ তাঁর নজর এড়াল না। পত্নীব্রত স্বামীর মতোই শিবঠাকুর দেবীকে
প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পার্বতীর চোখে পড়ল মধুরার স্তনের উপর মহেশ্বরের
ভস্মের চিহ্ন। আর যায় কোথায়! রেগে আগুন হলেন পার্বতী। শিবকে তিরস্কার করেও তাঁর
রাগ শান্ত হল না। মধুরাকে শাপ দিলেন – তুই কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাক!
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় এটাই যে পার্বতী
কিন্তু শিবকে অভিশাপ দেননি! নিজের কপালকেই দুষলেন বরং। অপরাধের সব দায় তো সেই
সত্যযুগ থেকেই নারীর। “হীরের আংটি”রা সোজা না ব্যাঁকা সেটা ধর্তব্যের মধ্যে কোনকালেই
ছিল না।
শিবঠাকুরের বোধহয় একটু খারাপ লেগেছিল।
তাই তিনি দেবীকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে অভিশাপটাকে একটু হালকা করে দিলেন। মধুরা এক নোংরা
কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবে আজীবন নয়, মাত্র বারো বছর! শুধু তাই নয়, এই ‘সামান্য’ কটা দিন কেটে গেলেই সে
তার সুন্দর রূপ ফিরে পাবে এবং এক মহা পরাক্রমী বীরকে স্বামী রূপে লাভ করবে।
মধুরার আর কোন আপশোষ না থাকারই কথা!
কশ্যপমুনির ছেলে মায়াসুর আর তার বউ
অপ্সরা হেমার দুই ছেলে। মায়াবী ও দুন্দুভি। কিন্তু একটি মেয়ের বড় শখ তাদের। তাই দুজনে মিলে বনে গিয়ে শিবের তপস্যা করছিলেন।
সেই সময় মধুরার বারো বছর পূর্ণ হলো। নির্জন বনের কুয়ো থেকে মেয়ের গলার কান্না শুনে
সেখান থেকে মধুরাকে উদ্ধার করলেন এই দম্পতি। এই কন্যা শিবের দান জ্ঞানে তাকে নিয়ে
মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে এলেন। নাম রাখলেন মন্দোদরী।
দিন যায়। একদিন শিবের বর সত্যি করে
রাক্ষসরাজ রাবণের সঙ্গে মন্দোদরীর বিয়ে হলো। যথাসময়ে তাঁদের তিনটি ছেলে হলো –
মেঘনাদ, অতিকায় আর অক্ষয়কুমার। শৌর্যে বীর্যে মেঘনাদই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাবার চোখের
মণি।
মন্দোদরী পতিপ্রাণা পত্নী। তিনি রাবণকে
নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তবু স্বামীর কোন কাজ অন্যায় বলে মনে হলে, তার
প্রতিবাদ করতে কখনো পিছু হটেন না। কিন্তু, সেই চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিকতার সমস্যা!
বউয়ের কথা যতই যুক্তিযুক্ত হোক, রাবণ তা মোটেও শোনেন না।
অতএব মন্দোদরীর বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও
রাবণ বেদবতীকে ধর্ষণ করবেন এবং অভিশপ্ত হবেন – কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাতে
উপগত হলে রাবণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে। রামায়ণের কিছু সংস্করণ অনুযায়ী এই বেদবতীই
পরে সীতা হয়ে জন্ম নেন এবং রাবণবংশ ধ্বংসের কারণ হন।
ইতিমধ্যে রাম সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে
পিতৃসত্য পালনের জন্য চোদ্দ বছরের বনবাসে এসেছেন। পঞ্চবটী বনে থাকাকালীন রামের
আদেশে শূর্পনখার নাক কান কেটে নিলেন লক্ষ্মণ। ছোটবোনের এহেন লাঞ্ছনায়
স্বাভাবিকভাবেই রাবণ খুব রেগে গেলেন। রামকে উচিত শিক্ষা দিতে তিনি ছদ্মবেশে সীতাকে
হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে এলেন। মন্দোদরী যথারীতি নিষ্ফল প্রতিবাদ করলেন। এই পর্যন্ত
ঠিক ছিল। কিন্তু সীতার রূপ রাবণকে উন্মত্ত
করে তুলল। তিনি সীতাকে বিয়ে করতে কৃতসংকল্প হলেন। সীতার প্রত্যাখ্যান তাঁকে আরও
ক্রুদ্ধ করল। কিন্তু বেদবতীর অভিশাপের দরুন তিনি অসহায়। সীতার সঙ্গে কোনরকম জোর
জবরদস্তি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রাগের মাথায় তিনি সীতাকে হত্যা করতে উদ্যত
হলেন। এইবার সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করলেন মান্দোদরী। মূলতঃ তাঁর জন্যই প্রাণে
বেঁচে গেলেন জনকনন্দিনী। কিন্তু, মজার কথা এটাই যে মন্দোদরী সীতাকে নীচকুলের মেয়ে
ভাবলেও স্বামীর প্রতি তাঁর একান্ত নিষ্ঠাকে তিনি শ্রদ্ধা করতে পেরেছিলেন। এমনকী তাঁকে দেবী অরুন্ধতীর সঙ্গে তুলনা করতেও
তাঁর বাধে নি। এই চিন্তার প্রসারতা বিশেষ করে সেই যুগে আমাদের বড়ই বিস্মিত করে।
ভুললে চলবে না, এ সেই যুগ, যেখানে শূদ্র হযে বেদ পড়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা
করেন সর্বশাস্ত্রনিপুণ যুগাবতার রামচন্দ্র স্বয়ং।
মন্দোদরী রাবণকে আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা
করেন যে, এক সামান্যা নারীর জন্য রামের মতো মহাবীর এবং প্রভাবশালী রাজপুত্রের
সঙ্গে শত্রুতা করা কোন কাজের কথা নয়। বিশেষতঃ
তাঁর দৈবী ক্ষমতা ও তাঁর উপর দেবগণের অপার করুণার কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু রাবণের
ভারি বয়েই গেছে সে কথা শুনতে!
অতএব যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধের শুরুতেই
রাবণের ভাই বিভীষণ রাক্ষসদল ত্যাগ করে রামের পক্ষে যোগ দিলেন। এর ফলে রাক্ষসপক্ষের
অনেক গোপন কথা রাম আগেভাগেই জানতে পেরে যান। এই জ্ঞান তাঁর যুদ্ধজয়ে একটা বড়
ভূমিকা নিয়েছিল।
একে একে রাক্ষসদের সবাই মারা যেতে
লাগল। মন্দোদরী তাঁর তিন পুত্রকেই হারালেন। রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ, বিভীষণের পুত্র
তারিণীসেন – সকলেই মারা গেলেন। এবার রাবণের পালা।
রাবণ অত্যন্ত নিষ্ঠাবান পূজারী।
যুদ্ধযাত্রার আগে তিনি এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। একাসনে বসে সেই যজ্ঞ শেষ করতে পারলে
তাঁকে আর কেউ হারাতে পারবে না। তিনি হবেন অজেয়। স্বভাবতঃই এই খবর রামের চিন্তা
বাড়ালো। বিভীষণের পরামর্শে তিনি অঙ্গদকে পাঠালেন যজ্ঞ পণ্ড করতে। অঙ্গদ যজ্ঞস্থলে
গিয়ে মন্দোদরীর চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। স্ত্রীর অপমানের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল
রাবণের নিজের সুরক্ষার চিন্তা। তিনি আসন ছেড়ে উঠলেন অঙ্গদকে শায়েস্তা করার জন্য।
অঙ্গদ তো এটুকুই চাইছিল। সে যঃ পলায়তি স জীবতি অনুসরণ করে প্রাণ রক্ষা করল। এরপরেও কিন্তু রাবণকে মারার পথ প্রশস্ত
হল না। কারণ, রাবণকে মারতে হলে একটি বিশেষ তীর চাই এবং সেই একমাত্র বিশেষ তীরটি
মন্দোদরীর কাছে গোপনে সুরক্ষিত থাকে। বিভীষণের কাছেই এ তথ্য জানা গেল। মন্দোদরীর
সরলতার সুযোগ নিয়ে হনুমান কৌশলে তাঁর কাছ থেকে সেই বিশেষ তীরটি চুরি করে আনল। এরপর রামকর্তৃক রাবণবধ তো শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আর মন্দোদরী?
আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে তারার মতো আরেক শোকাকুলা রমণীকে পাই – যিনি রামের দ্বারা
সহমরণে বাধাপ্রাপ্ত হলেন। হয়ত বা রামের প্রবোধ বাক্যে তিনি কিছু সান্ত্বনা পেয়ে
থাকবেন। কিন্তু তিনি বিভীষণকে বিবাহ করতে সম্মত হলেন না। পরিবর্তে নিজেকে অন্তরীণ
করে রাখলেন রাজপ্রাসাদের নিভৃত কোণে। তাঁকে বিরক্ত করার সাহস কারো হলো না! তারার থেকে
এইখানে তিনি স্বতন্ত্র। তারার দুর্বলতা ছিল পুত্র অঙ্গদ। কিন্তু মন্দোদরীর সন্তানেরা
সবাই যুদ্ধে বীরগতি লাভ করেছিল। তাই তাঁর কোন
দায়বদ্ধতা ছিলনা।
কিন্তু,
সত্যিই কি তাই? তাহলে এর কিছুদিন পরে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে আবার জনজীবনে
ফিরে বিভীষণকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নিলেন কেন? চমকের এখানেই শেষ নয়,
রামায়ণকার বলছেন, এ নিতান্তই এক কূটনৈতিক বিবাহ। মন্দোদরী কখনোই তাঁর স্বামী,
পুত্র ও বংশনাশের অন্যতম কারিগরটিকে স্বামীর মর্যাদা দেননি! তবে রাজ্য পরিচালনার
কাজে সহায়তা করেছেন।
মহাকবি
মন্দোদরীর জন্য আর কালি খরচ করেননি। কিন্তু মন্দোদরীর এই সিদ্ধান্ত আমাদের মনে
অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিভীষণকে স্বীকারই যদি না করবেন, তাহলে এ বিবাহের কী
প্রয়োজন ছিল? তাহলে কি রাক্ষস সমাজ একজন গৃহশত্রুকে তাদের অধিপতি হিসেবে মানতে
রাজি হচ্ছিল না? রাজ্যকে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতেই কি মন্দোদরীর এই
পদক্ষেপ? মনে হয় তাই। নয়তো সেই পুরুষপ্রধান যুগে বিভীষণ মন্দোদরীর এই অবস্থান মেনে
নিতেন না নিশ্চয়। সিংহাসন বাঁচাবার জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এই শর্তে রাজি হতে।
অবশ্য এসবই আমার যুক্তিনির্ভর অনুমান। প্রকৃত অধিকারী কেউ এ বিষয়ে আলোকপাত করলে
কৃতজ্ঞ থাকব।
তারাও খানিকটা
এইসব কারণেই সুগ্রীবের পতিত্ব স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মন্দোদরী তাঁর প্রতিবাদী
অবস্থানে অনেক বেশি উজ্জ্বল। আর এখানেই তিনি বাকিদের চেয়ে এক কদম এগিয়ে। তিনি
আপোষের রাস্তায় চলেননি।
মন্দোদরী
রাবণকে ভালোবেসেছিলেন। তাই তাঁর অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও দিনের শেষে স্বামীর অনুগত
হতে তাঁর বাধেনি। কিন্তু যখন তিনি বিভীষণকে রাজ্যের প্রয়োজনে স্বামী হিসেবে
স্বীকার করে নেন, তখন অন্দরমহলে তার জন্য এক অনতিক্রম্য পাঁচিল খাড়া করে দিলেন।
ত্রেতাযুগে তিনি যে অসীম মনোবল এবং স্বাধীন ভাবনার পরিচয় দিলেন, তা আজকের যুগেও এক
উদাহরণ হয়ে রইল। নারীর এই রূপ তৎকালীন সমাজভাবনার পক্ষে নিরাপদ নয় বলেই হয়তো
বাল্মিকী মন্দোদরীর এই আচরণের ব্যাখ্যায় যাননি।
*
*
*
এই পাঁচজন নারীকে শ্লোককার কন্যা বলে উল্লেখ করেছেন। এঁদের পরিচয় দিতে গিয়ে গৃ্হিনী,দুহিতা, সচিব, সখী, ললিতা এমন কি জননী শব্দটাও উচ্চারিত হয়নি। শ্লোককার কি এই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যে এই পাঁচজন শুধুই কন্যা? তাঁরা আপনার পরিচয়ে আপনি ভাস্বর। বাকি অভিধা তাঁর অলঙ্কার হতে পারে যদি সে চায়, কিন্তু তার পরিচয় সে নিজে।
এই নগ্ন সত্য বড় কঠিন। তাই কি রূপকের আড়ালে ঠেলে দিয়ে পুজোর বেদীতে বসাবার চেষ্টা? জীবজগত যে পঞ্চভূতে তৈরি সেই জল, আগুন. মাটি, বাতাস আর আকাশের সঙ্গে তুলনা টানা হল অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা আর মন্দোদরীর? জলের স্বচ্ছ্বতা, আগুনের তেজ, মাটির সহনশীলতা, বাতাসের অনিবার্যতা এবং আকাশের উদাসীন সর্বব্যাপী ভাবনার সঙ্গে এই পাঁচ নারীর তুলনা। জীবজগতের সৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মাতৃরূপেন সংস্থিতার পূজার্চনা। এর একটা কারণ বোধহয়, রমণীর এই মাতৃরূপেই পুরুষ নিজেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং অসমালোচিত মনে করে।
রূপক ছেড়ে যদি সাধারণভাবে এই পাঁচজনের জন্ম ও জীবনকথার দিকে তাকাই তাহলে আমরা কী দেখি?
প্রথম কন্যা অহল্যা অযোনিজ। তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসকন্যা। পৃথিবীর মরমানুষের মলিনতা তাঁকে স্পর্শ করে না। নগরজীবন থেকে অনেক দূরে একান্ত প্রকৃতির কোলে তপোবনের পবিত্র পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর সারল্য প্রশ্নাতীত। বিবাহসূত্রে মহামুনি গৌতমের পত্নী।
দ্বিতীয় কন্যা দ্রৌপদী। ইনিও অযোনিজ। তবে রাজা দ্রুপদের সন্তানকামনার যজ্ঞের আগুন থেকে তাঁর আবির্ভাব। মানুষী প্রার্থনা আর দেবতার আশীর্বাদের মিলিত ফসল। রাজপরিবারে বড় আদরে সম্মনে বড় হয়ে ওঠা। তেজস্বিনী এই নারী পঞ্চস্বামীর পত্নী।
তৃতীয় কন্যা কুন্তী। রাজবংশে সাধারণ মানবজন্ম। শৈশবেই মা-বাবাকে ছেড়ে অন্য রাজার আশ্রয়ে দাসীর সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠা। অপারগ স্বামীকে সন্তান দান এবং পরবর্তী জীবনে তাদের সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মতো লড়াইটা তিনি জয় করতে পেরেছিলেন।
চতুর্থ কন্যা তারা। দেবতা, রাজপরিবার ছেড়ে এবার সাধারণ ঘরে নেমে এসেছেন শ্লোককার। তারার পিতা অনার্য রাজবৈদ্য। তিনি বিবাহসূত্রে রাজরানী। সামাজিক রীতিনীতি মেনেও পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমানভাবে রাজ্যচালনায় সক্ষম এক নারী।
পঞ্চম কন্যা মন্দোদরী – দেবতাদের চিত্তবিনোদনে নিবেদিত এক অপ্সরা। তবুও মহেশ্বরের ইচ্ছাপূরণের দায়ে অভিশপ্ত জীবন। এরপর এক অনার্যের কন্যারূপে পালিতা। রাক্ষসরাজ রাবণের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যু পরে নিজের শর্তে জীবন কাটাতে পারা এক বিদ্রোহিনী।
জন্মের
এই ক্রমপর্যায়টি বেশ বিস্ময়কর। নয়? শুরু হয়েছিল সম্পূর্ণরূপে দেবাংশী দিয়ে। তারপর
ধীরে ধীরে দেবতা ও রাজকুলের মিলন। সেখান
থেকে নিতান্ত মানুষী মিলনে রাজপরিবার থেকে এলেন কুন্তী। চতুর্থ কন্যাটি সাধারণী –
ডাক্তারের ঘরের মেয়ে। আর পঞ্চমজন? তিনি অপ্সরাকন্যা! পিতা ময়দানব। মানে স্থপতি। গুণীজনকে ক্রমটি অনুধাবন করতে
বলব।
জন্ম ছেড়ে এবার এঁদের কর্মের দিকে চোখ ফেরানো যাক।
দেখা যাক সেখানে কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে এঁদের জীবনধারা।
অহল্যা – ব্রহ্মার অহৈতুকী পরীক্ষার ফসল। তিনি সমস্ত সৌন্দর্য, সারল্য এবং সততা দিয়ে এক নারী সৃষ্টি করে, সমাজজীবন থেকে দূরে এক ব্রহ্মচারী তপস্বীর আশ্রমে রেখে এলেন। উদ্দেশ্য অতি মহৎ - গৌতমের সংযম পরীক্ষা! গৌতম সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে ইন্দ্রকে আর এত কষ্ট করতে হতো না। তাঁর নর্তকীসভার একজন সদস্য বেড়ে যেত এমনিতেই। তা যখন হলো না, তখন তিনি তাঁকে পাত্রস্থ করলেন।
গৌতমপত্নী অহল্যার যৌবনের প্রথম অতিথি ইন্দ্র। ইন্দ্রের কাছে অহল্যা এক প্রাপণীয়া নারী। অন্যতম, কিন্তু একমাত্র নয়। আমার প্রগলভতা মাপ করবেন গুণী পাঠক। আমার চোখে কিন্তু অহল্যার কাছে ইন্দ্র একমাত্র প্রেমিক পুরুষ – যে অহল্যার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকে, হয়তো বা ফুল রেখে যায় পদপ্রান্তে, অহল্যাকে প্রথম যে শোনায় – তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়!
তাই মিলনশেষের পরে অহল্যাকে যখন গৌতম নিরাহারা, বায়ুভক্ষ্যা আর অদৃশ্য হয়ে থাকার অভিশাপ দিলেন, তখন সে তা মাথা পেতে নিল। কিন্তু তার মনের প্রত্যন্ত কোণা থেকেও ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে কোনো অভিশাপ উচ্চারিত হল না। ইন্দ্রের তরফে যাই থাক, নিজের ভালোবাসা, ভালোলাগার প্রতি সৎ থাকা থেকে সে বিচ্যুত হলো না।
অহল্যার জীবনে চতুর্থ পুরুষ রামচন্দ্র। মহামুনি গৌতমের বর অনুযায়ী যাঁর স্পর্শে অহল্যার মুক্তিলাভের কথা। রামেরও বোধহয় প্রয়োজন ছিল এই ঘটনার মাধ্যমে নিজের শৌর্য, ঐশ্বরিকতা প্রমাণ করা। তাই হয়তো অহল্যাকে মানবীরূপ ফিরিয়ে দেওয়া। মানে আরও একবার ব্যবহৃত হলেন অহল্যা! এবার তাঁকে গৌতমের কাছে ফিরে যেতে হবে।
কেউ লিখে যাননি, কিন্তু আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই – মাথা উঁচু করে নির্মোহ অহল্যা ফিরে চলেছেন গৌতমের গৃহের দিকে। কারো কাছেই যাঁর আর কিছু চাইবার নেই। তাঁর পায়ের কাছে পড়ে রইল ব্রহ্মার পরীক্ষা, গৌতমের ক্রোধ, ইন্দ্রের প্রেম কিংবা রামের করুণা। মানবজীবনের বাকি দায় এবং কর্তব্যটুকু সম্পন্ন করার জন্য এগিয়ে চললেন স্বচ্ছতোয়া জলের মতো এক নারী।
তেজসরূপিনী দ্রৌপদী পঞ্চজনার পত্নী। মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বহুবিবাহ চিরকালই ঘৃণার্হ। অথচ পাঁচ পাঁজন স্বামী নিয়েও যিনি রাজেন্দ্রাণীর মতো রাজভা উজ্জ্বল করে বসেন, বনবাসের সময় যাঁর আতিথ্যে মুনি ঋষি তপস্বী সবাই প্রীত হন – তাঁর চরিত্রবলের কথা ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি!
প্রধানা পাণ্ডবমহিষী তিনি। নিঁখুত তুলাদণ্ডে তৌল তাঁর ব্যবহার। তাঁকে নিয়ে পাঁচজনের মনে কোন ক্ষোভের জায়গা নেই। বরং সেখানে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মানের আসন পাতা। তাঁর সামান্য ভুলেই চিড় ধরতে পারত পাণ্ডবদের ঐক্যে। যদি তাঁর কারো উপর কোন পক্ষপাত থেকেও থাকে, অপূর্ব সংযমে তার আভাস ছিটকে বের হয় না কোথাওই। সবাই তাঁকে নিয়ে তৃপ্ত, কৃতার্থ। বনবাসেই হোক বা মহাপ্রস্থানের পথে - পাণ্ডবদের অচ্ছেদ্য অংশের নাম দ্রৌপদী। যদিও পাণ্ডবদের প্রত্যেকেরই আরও পরিণীতা পত্নী ছিলেন, কিন্তু তাঁকে ছাড়া পঞ্চপাণ্ডব অসম্পূর্ণ। কী অসীম ধৈর্য, বিবেচনা, হৃদয় ও কর্তব্যবোধ থাকলে এ সম্ভব – তা ভাবলে বিস্ময়ের কূল কিনারা পাওয়া যায় না।। পাঁচ স্বামীর ঔরসে দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে। একজন বেশিও নয়, কমও নয়! মাহাভারতীয় এই বার্তাটি আমাদের মরমে প্রবেশ করল কি?
ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধি, শ্রীকৃষ্ণের মতো এক যুগপুরুষের সখ্যতা, তাঁকে আরও পরিণত আরও ঋদ্ধ করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দ্রৌপদী অনন্যা তাঁর স্বীয় চরিত্রবলেই। অগ্নিস্বরূপা এই নারী প্রয়োজনে দাহিকাশক্তি হয়ে কৌরবকুল ধ্বংস করতে পারেন, আবার স্বামীদের সংশয়ের অন্ধকার দূর করতে হতে পারেন আলোকবর্তিকা।
কুন্তী – ক্ষত্রিয়কন্যা,বধূ, এবং মাতা। নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন ছিন্নমূল হবার যন্ত্রণা এবং অভিশাপ। তাই সন্তানদের প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বস্ব বাজি রাখতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করেননি। বস্তুতঃ ক্ষাত্রধর্মে দীক্ষিতা এই নারীর কাছে নিজপক্ষ পরপক্ষ সুনির্দিষ্ট। যে পাঁচটি প্রাণের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ, তাদের প্রতি কর্তব্যকর্মে তাঁর কোন চ্যুতি দেখা যায় না।
দুর্বাসার কাছে পাওয়া জীবনের প্রথম বর। ফল কি হল? কামনার পুরষটি এলেন, ভোগ করলেন, চলে গেলেন। সারাজীবনে আর ফিরেও তাকালেন না। নিজ পিতার দ্বারা পরিত্যক্ত, দাসীর হাতে বেড়ে ওঠা মেয়েটির আর কিই বা করার ছিল – প্রথম সন্তানকে ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া? আর শুধু তো একবার নয়, বারবার কর্ণকে ত্যাগ করতে হয়েছে কুন্তীকে। তাতে মাতৃহৃদয় যতই রক্তাক্ত হোক, দায়িত্বপালনে কোন ত্রুটি হয় না তাঁর। তাঁর সেই যন্ত্রণার ছবি মহাভারতকারও আঁকার চেষ্টা করেননি। বোধহয় ভালোই করেছেন।
অথচ এই রমণীর নিজের জীবন কেটেছে হয় অবহেলায়, নয়তো দারিদ্র্যে। অবশেষে যখন সত্যিই তাঁর পুত্রেরা প্রতিষ্ঠিত হল, তখন সর্বস্ব ত্যাগ করে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর হাত ধরে জীবনের তৃতীয় আশ্রমের দিকে পা বাড়াতে তাঁর একটুও দ্বিধা হলো না।
এক সর্বংসহা জননী, এক ক্ষুরধার ক্ষত্রিয়াণী – তাঁর সমস্ত কর্মের সমস্ত ফসল সন্তানদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যান বাণপ্রস্থে। হয়তো বা আর এক সন্তানের জন্য চোখের জল ফেলতে, নিজেকে অগ্নিশুদ্ধ করতে। আমরা মনে করতে বাধ্য হই – পৃথা সারাজীবনে নিজের সুখের জন্য, স্বার্থের জন্য কোন কাজ করেননি। তিনি যা কর্তব্য বলে, ধর্ম বলে জেনেছেন – নিষ্কামভাবে তাই পালন করেছেন। ধরিত্রীর মতোই তাঁর ফসল, সম্পদ, সাধনা সবই পরার্থে।
তারা – বালী ও সুগ্রীবপত্নী, অঙ্গদজননী। তীব্র ব্যক্তিত্বশালিনী এই নারীর সামনে স্বয়ং পরমপুরুষ শ্রীরামচন্দ্রও বাক্যহারা। বস্তুত বালীর মৃত্যুর পর যে শাণিত ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন তারা, তা আজও কোন ডিবেটরকে শিক্ষা দিতে পারে। প্রখর বুদ্ধিমতী এই নারী যেভাবে এই চূড়ান্ত শোকের সময়েও নিজের আবেগের ঊর্দ্ধে গিয়ে বাস্তববোধের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি সামলেছেন, তাতে শ্রদ্ধায় মাথা নত করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো পথ থাকে না।
তারা দুবার সুগ্রীবের পত্নীত্ব স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের সামাজিক প্রথা মেনেই। দ্বিতীয়বার কিছুটা হয়তো পরিস্থিতির চাপেই। তবু যে সম্পর্ক তিনি মেনে নিয়েছেন, তার দাবী মিটিয়ে দিতে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি। বালীর প্রতি তাঁর প্রেম প্রশ্নাতীত। প্রিয়হন্তা রামের অনুচরকে বিয়ে করতে গিয়ে তাঁকে যে দুস্তর মানসিক বাধা ও যন্ত্রণা পার করতে হয়েছিল, তার কোনো বর্ণনা রামায়ণে পাই না। মহাকবি তা লেখেননি। তারার মনের খবর কেউ পেল না। শুধু যখন রাম লক্ষ্মণকে সুগ্রীবের কাছে পাঠালেন, সীতা অন্বেষণে বিলম্বের কৈফিয়ৎ নিতে – তখন তারা উপযুক্ত বেশবাস না করেই সুগ্রীবের বাহুপাশ ছিন্ন করে দ্রুত লক্ষ্মণের কাছে হাজির হয়েছিলেন। অনেকে তারার এই আচরণের দিকে আঙুল তোলেন। কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হয়, তারা তখন এইসব বোধের অনেক ঊর্দ্ধে। তিনি তো পুত্রের প্রয়োজনে, জাতির প্রয়োজনে তাঁর লাজবস্ত্র, অভিমানের চাদর কবেই ফেলে এসেছেন অনেক পিছনে। তাই আজ যখন জাতির সংকটের দিন, তখন তাঁর তুচ্ছ বেশবাসের কথা মনে থাকার কথা নয়, থাকেও নি। সর্বহিতায় তিনি তো নিজেকে হাওয়ার মতোই বিলিয়ে দিয়েছেন নিঃশব্দে, নিঃশেষে।
মন্দোদরী – জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, অন্যায় দণ্ডভোগ করে তারপর তিনি রাবণমহিষী। সমাজের দাবী তাঁর নিজস্ব মতামতকে বাঁধতে পারেনি। তিনিও রাক্ষসরাজ্য টিঁকিয়ে রাখার জন্য বিভীষণকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আপন শর্তে। তিনি পঞ্চকন্যার জগতে প্রথম বিদ্রোহিনী, যিনি পরিস্থিতি এবং নিজের আকাশ একসাথে বাঁচিয়ে রাখতে জানেন।
এই যে ক্রমবিন্যাস – এর সবটাই কি সমাপতন? একটু কষ্টকল্পনা লাগছে না কি? কি বলতে চেয়েছেন শ্লোককার? নারীর পরিচয় জন্মে নয়, তার পাতিব্রত্যে নয়, এমনকি সমাজ আরোপিত যৌন সততাতেও নয়। তার পরিচয় তার কর্মে, তার বিশ্বাসের সততায়, চারিত্রিক দৃঢ়তায়? সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা এই পাঁচ নারী একই কর্মসূত্রে বাঁধা। সামাজিক বাধানিষেধ অতিক্রম করে তাঁরা পুরুষের সঙ্গে একাসনে বসেছেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সমাজ তাঁদের দিকে বারবার বাড়িয়ে দিয়েছে বেদনার বিষে নীল পেয়ালা। তাঁরা পান করেছেন, যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়েছেন, কিন্তু স্বধর্মচ্যুত হননি। সমাজ তাঁদের নাম জপ করেছে তাঁদের ভুলতে পারেনি বলেই। প্রভাতে নামজপ করেছে, কিন্তু সন্ধ্যায় নিজের মেয়েকে বলেনি – এদের মতো হও। বলেতে পারেনি, হয়তো মানতেও পারেনি যে – হৃদয়ের স্থান, সত্যের স্থান সমাজের উপরে।
তবু তাঁরা আসেন যুগে যুগে। তাঁদের স্মরণে মহাপাপ বিনষ্ট হয়। মহাপাপ কি? আমার স্বল্পবুদ্ধিতে মনে হয়েছে ভয়ের চেয়ে বড় পাপ আর কিছু হয় না। ভয় – সমাজের ভয়, নিশ্চিন্ত আশ্রয় হারাবার ভয়, লোকলজ্জার ভয় - আমাদের যত পতিত করে, সংকল্পচ্যুত করে – তত আর কিছুতে করে না। পঞ্চকন্যার জীবনধারা বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হলেও এই একটি জায়গায় তাঁরা সবাই এক। তাঁরা নির্ভয়। যন্ত্রণা দিয়ে, অপমান আর অবিচার করেও সমাজ তাঁদের মেরুদণ্ড বাঁকাতে পারেনি। তাই তাঁরা সত্য জীবনের দিগদর্শক। তাই তাঁরা প্রণম্য।
||সমাপ্ত ||
1 comment:
প্রিয় লেখিকা, আপনার প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চমন্যার পাঁচটি লেখাই প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। আপনার উপসংহার অনুচ্ছেদ টি আমার সর্বজনীন ও সর্বকালীন মনে হয়েছে। ভয়েরই আরেক নাম মহাপাপ। আপনাকে সাধুবাদ জানাই।
Post a Comment