TO WHOM IT MAY
CONCERN
মারহাবান ইয়া সাদিকী – প্রিয় বন্ধু হে,
সমুদ্দুরে হারিয়ে যাওয়া নাবিক যেমন ছিপি আঁটা বোতলে চিঠি লিখে ভাসিয়ে দেয়, তেমনি এ চিঠি আমি ভাসিয়ে দিলাম অন্তর্জালের সাগরে। কবে কোথায় কার হাতে পৌঁছাবে আমি জানি না। হয়তো হারিয়ে যাবে শত সহস্রকোটি শুভেচ্ছা, সেলফি, ছবি, লেখার ভিড়ে। হয়তো কোনো দরদী বন্ধুর চোখে পড়বে – তারপর? হয়তো দুফোঁটা জল গড়াবে তার চোখ দিয়ে। কিংবা.... কিংবা তার চোখে জ্বলে উঠবে আগুন – অনিয়ম আর অবিচারের বিরুদ্ধে একটুকরো স্ফুলিঙ্গ। অথবা – আমি জানি তার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি – একটা ছোট্ট “আহা”-র অবজ্ঞার তলায় চাপা পড়ে যাবে সবকিছু। আমাদের এটাই ভবিতব্য যে!
আজ রোদ উঠছে। ভূমধ্যসাগরের জল নীল নয় আজ। একটা গান আছে না? “আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে?”
আমার ক্ষেত্রে - “আকাশ আমার ভরল ধোঁয়ায়, আকাশ আমার ভরল
গানে”! শুধু এ গান সঙ্গীত নয়। আকাশ থেকে পড়া বোমার হুঙ্কার!
আমার এক বাঙালি বন্ধু ছিল, জান? তোমরা কি যেন বলো – ভার্চুয়াল
ফ্রেন্ড! তা, সেই আমায় মাঝে মাঝে শোনাত এইসব অলৌকিক দিব্য সঙ্গীত। আমি ভাবতাম –
এমন দেশ হয়? যেখানে আছে শান্ত সকাল, অলস দুপুর, সুন্দর সন্ধ্যা আর নিশ্চিন্ত ঘুম?
এই দেখো দিকি?
এলোমেলো কথার ভিড়ে আসল কথারা কেমন টুপটাপ ঝুপঝাপ হারিয়ে যায়! যেমন হারিয়ে গেছে
আমার শৈশব। হারিয়ে যাচ্ছে আমার যৌবন....। নাঃ, এর পরে আর ভাবি না। জীবনের এতখানি
দেখা হলো এই তো ঢের। বার্ধক্য দেখার সুযোগ পাবো কি পাবো না সে কথা কি কেউ বলতে
পারে? আমাদের এই গাজ়া স্ট্রিপে সব কিছুই ভীষণভাবে অনিশ্চিত।
হয়ে গেল! এই যে
বললাম, অমনি তোমাদের মুখ বেঁকে যাচ্ছে বিরক্তিতে। চিঠিটা ফেলে দিয়ে উঠে যাচ্ছ
দৈনন্দিন জরুরি কাজে। আমরা খুব ছোট্ট দেশে থাকি। আমাদের থাকা না থাকায় কারো কিচ্ছু
এসে যায় না। বিশ্বের প্রথম দেশে যখন হামলায় তিন হাজারের মতো লোক মারা যায়, তখন
বিশ্ব একযোগে যে ছিছিক্কার উঠেছিল, তাতে বড় স্বস্তি আনন্দ পেয়েছিলাম, জানো। তবে,
মানবিকতা তো এখনও আছে! আছে অকারণ মৃত্যুর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার মতো অনেক অনেক
মানুষ!
আর আজ যখন এখানে
সাত হাজারেরও বেশি প্রাণ...
আমাদের পাশে কেউ
নেই।
ভূমধ্যসাগরের
পূর্বতীর ঘেঁষে যে একফালি জমি ফিতের মতো পড়ে থাকে – যার একটা ছোট্ট কোণা ছাড়া বাকি
জমি ধরে ইজরায়েলের সীমান্ত – সেটাই আমার দেশ – গাজ়া স্ট্রিপ।
আমাদের কয়েক পরিবারের
ছোট্ট গরীব আস্তানা। তারপর, একফালি জমি। লম্বা যে রাস্তাটা চলে গেছে, তার ওপারেই
ইজরায়েল। রাস্তায় সেনার পাহারা। ওপারে যাবার উপায় নেই। ওপারে তকতকে বাড়ি, ঝকঝকে
মানুষ, বকবকে বাচ্চা। কি যে সুন্দর টোলফেলা গাল তাদের! আমাদের মতো তারা শীর্ণ
ক্ষীণজীবি নয় মোটেই। অনেক লোক বেড়াতে আসে সেখানে। আমাদের মা বোনেরা মিলে সারাদিন কী সব তৈরি করত..
বাবা আর দাদা রাস্তার ওপারের বেড়াতে আসা মানুষদের কাছে সেই সব জিনিস বেচবার চেষ্টা
করত আপ্রাণ। সীমা পার করার চেষ্টা না করলে সেনারা কিছু বলত না।
সে যেন কোন অতীতের
কথা! কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ আমি জানি না। হামাস যদি কিছু করতে বলে, আমরা তা করতে
বাধ্য। না করলে আমাদের মারতে ওদের এতটুকু সময় লাগবে না। আর ইজরায়েলের ওপর হামলা
হলে ওরাও বসে থাকবে না। আক্রমণ হলে মরব সেই আমরাই – যারা হামাস নই, ইজরায়েলী সৈন্য
নই, গাজ়ার সাধারণ মানুষজন। তোমরা যার নাম দিয়েছ হিউম্যান শিল্ড! কিন্তু আমি তো
শিল্ড হতে চাইনি! আমি খলিল, আমার বাবার নাম ইব্রাহিম, দাদা জামিল, মা ইনায়া.....।
আমি তোমাদের মতো নই কেন বলতে পারো?
সীমানা ছেড়ে,
বাড়ি ছেড়ে সমুদ্রে ধারে চলে এসেছি। কালকেও বোমা পড়েছে পাশের পাড়ায়। এরপর আর কোথায়
যাব আমরা। মেডিটেরিনিয়ানের তলে?
বিশ্বেশক্তি
আমাদের জন্য এই ভূমি ঠিক করে দিয়েছিল। সমুদ্রে ধারে রুক্ষ বালুকাময় এক চিলতে জমি।
তাও...
কেন বাঁচতে পারি
না আমরা? কেউ জানো?
বিমানের শব্দ
পাচ্ছি। আজ যেন একেবারে মাথার ওপর...। কে জানে? আজ হয়তো....। হে জিহোভা! চিঠিটা কি কোনোদিন শেষ করতে পারব? যদি না পারি,
তাহলে মনে রেখ আমি খলিল, আমার বাবার নাম ইব্রাহিম, দাদা জামিল, মা ইনায়া .... আমি
যীশুকে ক্রুশে ঝোলাইনি, প্যালেস্তাইনে যখন আমার দাদু এসেছিলেন তখন তিনি ষোলো বছরের
কিশোর....। আমি তোমাদের ম..তো..ই....
দোলা সেন||
[ছবিঋণ আন্তর্জাল]
1 comment:
বড় বিষাদ। মনখারাপ।
Post a Comment