অবৈধতা আইন – দক্ষিণ আফ্রিকা – ১৯২৭
১) যদি কোন ইউরোপিয়ান (পড়ুন শ্বেতাঙ্গ) পুরুষ কোন আদিবাসী (পড়ুন কৃষ্ণাঙ্গ)
মহিলার সঙ্গে অথবা কোন আদিবাসী পুরুষ ইউরোপিয়ান মহিলার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেন, তাহলে
তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং অপরাধী পুরুষের সর্বাধিক পাঁচবছরের জেল হতে পারে।
২) যদি কোন ইউরোপিয়ান (পড়ুন শ্বেতাঙ্গ) পুরুষ কোন আদিবাসী (পড়ুন কৃষ্ণাঙ্গ)
মহিলার সঙ্গে অথবা কোন আদিবাসী পুরুষ ইউরোপিয়ান মহিলার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করেন, তাহলে
তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং অপরাধী মহিলার সর্বাধিক চারবছরের জেল হতে পারে।
এই তীব্র জাতিবিদ্বেষ যে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তি, সেখানে বর্ণসংকর
সন্তান শুধু অপরাধই নয়, রাষ্ট্রীয় ইমারতের একটি ফাটলবিশেষ। এরকম একটি ঘটনা ঘটতে
থাকলে তা রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা এবং অসংলগ্নতাকেই সামনে আনে।
কিন্তু মুস্কিলটা কি জানেন? মানুষ হচ্ছে মানুষ এবং তার সঙ্গমেচ্ছাও
সঙ্গমেচ্ছাই। আইন করে এ আর কে কবে আটকাতে পেরেছে? ফলে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও
সাদা-কালোর মিলনজাত সন্তান জন্মাতেই থাকল। শুধু অন্যদেশগুলো থেকে রঙের ব্যাপারে
অনেক বেশি খুঁতখুঁতে হওয়ায় দক্ষিণ
আফ্রিকাতে নতুন রকম চতুর্বর্ণাশ্রম চালু হলো – সাদা, কালো, ইন্ডিয়ান (পড়ুন এশিয়ান) এবং কালার্ড।
এটা কিন্তু মোটেও এলেবেলে ব্যাপার
নয়। রীতিমতো আইনের সিলমোহর মারা কেস। আমরা যেমন কোনো ফর্ম ফিল আপ করতে হলে লিখি – হিন্দু, মুসলিম,
ক্রিশ্চান.... তেনি ওরা লিখত –
White / Black / Indian / Colored! এখানেই
শেষ নয়। আমাদের বামুনপাড়া, বাগদীপাড়ার মতো সবার জন্য আলাদা আলাদা মহল্লা। কালো এবং
ইন্ডিয়ানদের সাদাদের এলাকায় ঘোরাঘুরির নিয়ম নেই। কালার্ডরা তো না ঘরকা, না ঘাটকা!
তা এই অবৈধ এবং অনভিপ্রেত ব্যবস্থা আটাকানো যায় কি করে? রোদে রাঙা ইঁটের
পাঁজার উপর বসে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন শাসকদল তারও প্রতিষধক বের করে ফেলল। ঠোঙা
ভরা বাদামভাজা নিয়ে বসেছিল নিশ্চয়ই! একদল নীতিপুলিশ নিযুক্ত হলো। তারা রাতে
গৃহস্থের ঘরের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতো কোনো বিছানায় এরকম অবৈধ জুটি আছে কিনা।
থাকলে ভাঙো দরজা, টেনে বের করো অপরাধীদের। তারপর মারধোর, হাজতবাস।
ইয়ে, একটা ছোট্ট কথা বলতে শুধু ভুলেছি। মানে বিশেষ কিছুই না, ঐ
ঘটনাক্রমগুলো বাস্তবে শুধুমাত্র ওয়ার্স হাফ, মানে কালো মানুষটির জন্য প্রযোজ্য।
সাদাটিকে আলাদা করে টেনে নিয়ে বলে দেওয়া হতো – “দোস্ত, মদের নেশায় এমন অজায়গায়
যেতে নেই। আর করো না কেমন?”
তা এইরকম যখন অবস্থা, তখন ছয়ের দশকের শেষভাগে খোষা নামের এক আদিবাসী
সম্প্রদায়ে প্যাট্রিসিয়া নোআ ( পুরো পদবীটা বাংলায় লিখতে পারছি না, কেউ সাহায্য
করলে ভালো হয়) নামে এক কালো মেয়ের জন্ম হলো। মেয়েটি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা,
স্বেচ্ছানুসারী এবং প্রচণ্ড ঈশ্বরভক্ত। সে যা চাইতো, সেটা পাবার জন্য কোনোরকম
কষ্টকর, বিচিত্র বা বিপজ্জনক কোনো পন্থাই বাদ দিত না। অতএব সে পড়াশোনা শিখে ফেলল।
তারপর তার মতো কালো মেয়েদের জন্য নির্ধারিত তিনটি জীবিকা – কারখানার শ্রমিক, গৃহপরিচারিকা
অথবা জনবধূ – তিনটেই ঘৃণাভরে বাতিল করল। এবার তাহলে কি হবে? তার কিছু বন্ধু যারা
শেষের বৃত্তিটি নিয়েছিল, তারা তখন তাকে একটা চমৎকার বুদ্ধি দিলো। প্যাট্রিসিয়া মহা
খুশি হয়ে পরিচারিকার আলখাল্লা পরে আরামে শ্বেত অধ্যুষিত এলাকায় ঘুরে বেড়াতে থাকল।
পূর্বোক্ত বন্ধুদের সাহায্যে ওই চত্বরে একটা সস্তার বাড়িভাড়াও জুটিয়ে ফেলল।
এই সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় কিছু কিছু সংস্কারক মাথা চাড়া দিয়ে উঠছেন। তাঁদের
কেউ কেউ কৃষ্ণাঙ্গ সেক্রেটারি রাখছিলেন। উদ্যমী প্যাট্রিসিয়া সেইরকম একটি কাজ
জুটিয়ে ফেলল। অবশ্য সেই পয়সার অধিকাংশই চলে যেত পুলিশে জরিমানা দিতে। মাঝে মাঝেই সে
“পরিচারিকার লাইসেন্সটি সঙ্গে নিতে ভুলে যেত” যে! জেল এড়িয়েছে কি করে তা ওর ঈশ্বরই
জানেন!
এর উপর সে নাচতে গাইতে ভালোবাসে। অতএব নাইটক্লাবে তার নিত্য যাতায়াত। সেখানে
কি করে যেন এক ছেচল্লিশের শান্ত, ধীর, স্থির পুরুষের সঙ্গে এই দামাল ছাব্বিশের
মনের যোগ হয়ে গেল। জাতিতে সুইস এই পুরুষের নাম রবার্ট। বেশ দিন কাটছিল। কিন্তু
তিরাশি সাল নাগাদ প্যাট্রিসিয়ার মনে হলো এবার তার একটা সন্তান চাই! এবং তা চাই ওই
রবার্টের কাছ থেকেই! এরপর কথোপকথন অনেকটা এইরকম –
-
আমার
একটা বাচ্চা চাই রবার্ট।
-
আমি
চাই না।
-
তোমাকে
চাইতে বলিনি। আমার চাই বলেছি। তুমি আমায় শুধু বীজ দিয়ে সাহায্য করবে। ব্যস।
-
আমি
ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক প্যাট্রিসিয়া। এ হতে পারে না।
-
খুব
পারে। আমি তো তোমাকে না জানিয়েও এটা করতে পারতাম। মানে এখনো পারি। তারপর আমি অন্য
জায়গায় চলে গেলে তুমি এসব জীবনেও জানতে পারতে না। কিন্তু আমি তা চাই না। আমি চাই
যে, তুমি জানো তোমার সন্তান আছে। ইচ্ছে করলে তুমি বাচ্চাটার সঙ্গলাভও করতে পারবে।
কিন্তু তার কোন দায়িত্ব তোমায় নিতে হবে না। সে শুধুমাত্র আমার পরিচয়ে আমার দায়িত্বে
বাঁচবে। বুঝলে?
অতএব এর কিছুমাস পরে ১৯৮৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী প্যাট্রিসিয়া একাই গিয়ে
ভর্তি হলো হিলব্রাউ হাসপাতালে। প্রসবের পর ডাক্তাররা প্রায় সাদা একটি ছেলেকে দেখে
স্পষ্টতঃই অবাক। এবার ফর্ম ফিল আপের পালা।
-
বাবার
নাম কি?
-
সে
সোয়াজিল্যান্ডের মানুষ। (প্রসঙ্গতঃ এটি দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বে চারপাশের সীমানায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে একটা ছোট্ট স্বাধীন
রাজ্য)
এভাবেই জন্ম নিল ট্রেভর নোআ। সে আইনত তার মায়ের মতো খোষা নয়, বাবার মতো
সুইস নয়। কারণ দেশের আইন তা অনুমোদন করে না। অতএব জন্মপত্রীতে তার বাবার নাম নেই।
জন্মপরিচয় অনুযায়ী সে একজন বিদেশী নাগরিক!
তাই বলে কি ট্রেভর তার পিতৃসঙ্গ পায়নি? তাও পেয়েছে। তবে
ভারি অদ্ভুতভাবে। হাঁটি হাঁটি পা পা শিশুটিকে নিয়ে প্যাট্রিসিয়া যখন পার্কে যেত,
তখন কখনো রবার্ট আসতো ছেলেকে দেখতে। তাকে দেখা মাত্র ট্রেভর বাবা বাবা বলে চেঁচালেই সে বেচারি আতঙ্কে দৌড়ে
পালাতো। ছোট শিশু আতঙ্ক বোঝে না। সে ভাবে এ এক মজার ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা। সে হাসতে হাসতে
চেঁচাতে চেঁচাতে লোকটির পিছু ধাওয়া করে।
এভাবেই শুরু একটি অনবদ্য বইয়ের – BORN A CRIME – লেখকের নাম – TREVOR NOAH! তার বিচিত্র ছেলে বেলা, এক ঘৃণা
আর অবিশ্বাসের পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। এই সব কিছুকে কখনো স্নিগ্ধ কখনো তীক্ষ্ণ
কৌতুকের আলোতে পরিবেশন করা মুখের কথা নয়। তার বড় হয়ে ওঠার মধ্যেই ঘটবে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক ও সাামাজিক
পরিবর্তন। নেলসন ম্যাণ্ডেলার প্রভাব প্রাত্যহিক জনজীবনে কতোটা পড়েছেল, তার একটি
অনন্য দলিল এই বই।
অথচ এই বইটি একটি দুষ্টু ছেলের বড় হয়ে ওঠার সরস গল্প। এক
ব্যতিক্রমী মায়ের আঁচলের ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক শিশুর গল্প। যে ছেলেকে মা কিডন্যাপারের
হাত থেকে বাঁচাতে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেয়। তারপরেও সে বেঁচে থাকে! যে বেড়ে ওঠায়
আশ্চর্যজনকভাবে হতাশা, বর্ণবিদ্বেষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা সব কিছু পিছলে বেরিয়ে যায়।
স্পর্শ করে কিন্তু বিদ্ধ করে না।
অনেকদিন বাদে একটি ভীষণ ভালো বই পড়লাম। লিখতে লিখতে
ইচ্ছে করছিল প্রতি ছত্রের অনুবাদ করে ফেলি। কিন্তু এই সরস লেখার সত্যিই অনুবাদ হয়
না। বইটি পড়ার পর মুগ্ধতার রেশ থেকে যাবে বহুদিন। অত্যন্ত সুপরিবেশিত এক চাঞ্চল্যকর
জীবনগাথা। টম ব্রাউনস স্কুল ডে’জ কিম্বা অলিভার টুইস্টের মতোই এক আনপুটডাউনেবল বই।
[Trevor Noah বর্তমানে আমেরিকার বিখ্যাত “The Daily Show” এর অন্যতম সঞ্চালক। তাঁর
রসবোধ, সরস বাচন এই শোকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।]
বইটির প্রকাশক - A Spigel & Grau, a division of Penguin Random House
No comments:
Post a Comment