Tuesday, February 12, 2019

অভিজ্ঞতার দাম


শেষ লাইনটা ঘাড় ধরে অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিল। তাই ....
 ***

সেই যে ঝুপসি বটগাছটার পিছনে তিনশ বছরের পুরোনো চার্চটা রয়েছে, তার লাগোয়া জমিটা ছিল এক কবরখানা। এখন সেখানে আর বিশেষ কেউ যায় না। শুধু  ছাপাখানার কর্মীর দল রাত ডিউটি সেরে ভোরবেলায় যখন ঘরে ফেরে, তখন পুরোন অভ্যাসবশে পোড়ো চার্চটায় ঢুকে প্রার্থনা করে নেয়।
আর তাই রোজ ভোরে বুড়ো জনকে আসতে হয় পবিত্র বারি ছিটিয়ে চার্চটা খালি করার জন্যে! বিড়বিড় করতে থাকে বুড়ো। তার হয়েছে যত জ্বালা। শেষ যিনি পাদ্রী ছিলেন তিনি জনকে ডেকে এই গুরুদায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নাকি ওই রাতের বেলায় যাঁরা ঘুরে বেড়ান, যাঁদের নাম নিতে নেই – তাঁদের দেখতে পেতেন। রাত্তির হলেই তেনারা কবর ছেড়ে এসে চার্চে ভীড় করে নাকি প্রার্থনা করেন, আর তারপর মাঠময় ঘুরে ঘুরে সুখদুঃখের গল্প করেন। পাদ্রীবাবা বলতেন দুই জগতের লোকেদের একসাথে না থাকাই ভালো। তাতে নানা বিপত্তি হতে পারে। আর তাই রোজ ভোরে জন সারা মন্দির আর কবরগুলোর চারধারে জল ছিটিয়ে মানুষদের জন্য জায়গা খালি করিয়ে দেয়।

পাদ্রীবাবা ঠিকই বলতেন। এই চার্চটার মতো কবরগুলোও তিনশ’ বছরেরে পুরোনো। অযত্নে আর দেখাশোনার অভাবে কবরের ওপরের ঢাকার প্লাস্টার খসে পড়েছে, ফাটলও ধরেছে। আর তাইতেই সুবিধা হয়েছে কবরের বাসিন্দাদের। রাত হলেই তারা সেই ফাটলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে।  আবার ভোর হতে না হতেই ফিরে যায় যে যার কফিনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। জনের জল ছেটানোর জ্বালায় দিনের বেলায় তাদের বাইরে থাকবার উপায় নেই। এই কবরগুলোর মধ্যে আবার বিশপের কবরটির ফাটল সবচেয়ে বড়। তার কারণও ছিল। তাঁর মহানতার খ্যাতি চারদিকে এতই ছড়িয়ে পড়েছিল, যে লোকে তাঁর কবরের ঢাকার প্লাস্টারের টুকরো ঘরে নিয়ে সাজিয়ে রাখত পবিত্র আত্মার প্রতীক হিসেবে।

তা এতদিন দুই জগতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বেশ ভালো ভাবেই চলছিল। ঝামেলা বাঁধল ঐ রাজমিস্তিরিটা আসার পর থেকে। সে তার বৌয়ের অসুখ সারাবার জন্য ঈশ্বরের দয়া চাইতে এই পুরোনো চার্চেই মোমবাতি জ্বালাতে এল। আর আশ্চর্য! বৌটা ভালোও হয়ে গেল দিব্বি। তখন আবার তার মনে হল তারও কিছু করা উচিত। তার যেটুকু সাধ্য তাতে তো আর গোটা চার্চ সারানো যাবে না, তাই সে ঠিক করল মহান বিশপের কবরটুকু সে সারিয়ে দেবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। পরদিন কাজে বেরোবার আগে ভোররাতে অন্ধকার থাকতে থাকতেই মালমশলা নিয়ে হাজির হয়ে গেল কবরস্থানে। সুন্দর করে সারিয়ে দিল যত ফাটাফুটি। তারপর খুশিমনে নিজের কাজে চলে গেল। ভূতের দল তখন চার্চে বসে গল্পগুজবে ব্যস্ত। এতসব কাণ্ড তাদের নজরেই পড়ল না। গোল পাকল আলো ফুটতে। সবাই তো যে যার কফিনে ঢুকে গেল। বেচারি বিশপ! তিনি এদিক ওদিক কতদিক দিয়েই যে চেষ্টা করলেন! বলতেই হবে রাজমিস্তিরিটির কাজ খুব নিখুঁত। একটা ছোট্ট ফাটলও কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এদিকে জনেরও পবিত্র জল ছেটাবার সময় হয়ে গেছে। হতাশ হয়ে তিনি খুঁজতে লাগলেন যদি কোন কফিন খালি পাওয়া যায়। খুঁজতে খুঁজতে তিনি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তখন হঠাৎ মনে পড়ল মার্লের স্যর জিওফ্রের কথা। তাঁর কবর এখানে হলেও বিগত দুশ বছর ধরে তিনি তাঁর মার্লে দুর্গেই থাকেন। খুঁজে পেতে ঢুকতে যাবেন, দেখেন সেখানে একটি বছর আঠেরোর মেয়ে শুয়ে আছে! মেয়েটিকে চেনেন বিশপ। প্রেমে ব্যর্থতার জন্য জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল। ওর শরীর কেউ খুঁজে পায়নি বলে ওর কোন কফিনও নেই। এবার কি করবেন বিশপ? এদিকে জন জল নিয়ে এদিকেই আসছে। - হে ঈশ্বর! প্রায় আর্তনাদই করে উঠলেন বৃদ্ধ মানুষটি। তার এই কাতরোক্তি কানে গেল মেয়েটির। তড়াক করে উঠে বসল – মহান বিশপ, আপনি এখানে কেন?

কি আর করেন বিশপ, সংক্ষেপে সব কথা খুলে বললেন। মেয়েটি বলল – হে মহান বিশপ। আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন। জল এড়িয়ে দৌড়াতে পারবেন না। তার চেয়ে আপনি এখানে শুয়ে থাকুন। আমি চটপট খুঁজে দেখি কোন থাকার জায়গা পাই কিনা।

তাই হল। বিশপ সুট করে শুয়ে পড়লেন কফিনের ভিতর। বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। এদিকে জন এসে পড়েছে, জল ছেটাচ্ছে চারিদিকে। আর মেয়েটি দৌড়ে পালাচ্ছে এক কবর থেকে আর এক কবরে। এইভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় সে পৌঁছে গেল কবরের গেটে। তাকে কি এবার তাহলে চলেই যেতে হবে? কষ্টে মেয়েটির মন ভরে গেল। এমন সময় সে দেখতে পেল চার্চ থেকে বেরিয়ে আসছে এক ছাপাখানার কর্মী লোকটির মুখ দেখে কেমন যেন ওর মনে হল এ তার চেয়েও দুঃখী। কৌতূহল হল মেয়েটির। মিস্তিরির পিছু পিছু সে চলল তার বাড়ি। গিয়ে দেখে সেই ছাপিয়ে আর তার বৌয়ের ছোট্ট শিশুকন্যাটি ভীষণ অসুস্থ। মরণাপন্ন বাচ্চাটার জন্য করুণা চাইতেই সে গিয়েছিল চার্চে। আকুল হয়ে তাই কাঁদছে ওরা।

তা যতই কাঁদুক, একসময় বউটি বাধ্য হল ঘরের কাজে যেতেআর  ছাপাইকর্মীটি গেল বাচ্চার জন্য জল আনতে। সেই ফাঁকে মেয়েটি এসে বাচ্চাটিকে ভালো করে দেখল। রুগ্ন শিশুটি এখুনি মারা যাবে। কান্না পেয়ে গেল ওর। আর ওর আশঙ্কা সত্যি করে বাবা ফেরার আগেই শিশুটির আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল! দুঃখী দম্পতির জন্য বড্ড মায়া হল মেয়েটির, আর বিদ্দ্যুচ্চমকের মতোই আর একটা সম্ভাবনা মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল। মুহুর্তমধ্যে টুক করে ঢুকে পড়ল বাচ্চাটার শরীরে। কর্মীটি জল নিয়ে এসে দেখে মেয়ের মুখ আনেক শান্ত দেখাচ্ছে। ভারি খুশি হয়ে বৌকে ডেকে দেখাল। বলল – দেখ ভাগ্যিস চার্চে গিয়েছিলাম!

কথাটা এক হিসেবে একদম সত্যি। চার্চে না গেলে মেয়েটির তো কর্মীর বাড়ি আসাই হতো না! আর তাহলে শিশুটির মৃতদেহ ঘিরে এতক্ষণে কান্নাকাটির ঝড় বইত। ভাবতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে মেয়েটি, আর তাই দেখে বাবা মায়ের সে কী আনন্দ!

এরপর আর কি। বাবা মায়ের আদরে বড় হয়ে উঠতে থাকে বাচ্চাটা। এখন সে রীতিমতো সুন্দরী এক মেয়ে। সে মাঝে মাঝেই চার্চে আসে, অনেকটা সময় কাটায় কবরখানায়ধারে কাছে কেউ না থাকলে চুপি চুপি গল্প করে বিশপের সাথে। বিশপকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল বলেই না সে আজ আবার জীবিতের জগতে ফিরতে পেরেছে। সে কৃতজ্ঞতা জানায় ফাদারকে। বিশপও মেয়েটিকে কন্যাসম স্নেহ করেন।
 একদিন সে এল ভারি খুশি হয়ে
-        ফাদার, আপনি নিশ্চয় অন্যের কফিনে শুয়ে শুয়ে ক্লান্ত! যেতে চান নিজের জায়গায়?
-       চাইলেই বা কি এসে যায়! আমার শুধু ভয়, যদি কোনদিন স্যর জিওফ্রে ফিরে আসেন, তাহলে.......
-       উপায় আমি পেয়ে গেছি ফাদার। আপনার কবরের পিছনের দিকের প্লাস্টারটা তত ভালো ছিলো না। আমি রোজ সেখানে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একটা বড় ফাটল তৈরি করতে পেরেছি। আজ সন্ধ্যায় দেখতে পাবেন। এখন ঐ ফাটল দিয়ে আপনি আগের মতোই ইচ্ছেমতো ঢুকতে ও বেরোতে পারবেন।
-        
পরদিন। সন্ধ্যেবেলায় মেয়েটি এসে দেখে বিশপ তাঁর নিজের কবরের পাশে বসে আছেন। তাঁর মুখে সেই আগের প্রসন্নতা ফিরে এসেছে। ভারি খুশি হয়েছেন তিনি। সেদিন অনেকক্ষণ কথা হল তাদের। চলে আসার আগে বিশপ বললেন
 – এখন তুমি এই জগত থেকে মুক্ত হয়ে গেলে। কৃতজ্ঞতার ঋণও তোমার শোধ হয়ে গেছে। কাল থেকে আর আমাদের তুমি দেখতে পাবে না। কিন্তু যাবার আগে তোমায় একটা কথা দিতে হবে আমায়। গতবারের মতো ভুল আর করো না যেন! ভালোবাসার জন্য আবার মৃত্যুবরণ করবে না বলো?

বিচিত্র হাসল মেয়েটি – হে আমার প্রিয় পিতা, আপনি সে ভয় করবেন না। প্রেমের জন্য মরেছিলাম যখন, তখন শরীরে এবং মনে আমি আঠেরো বছরের তরুণী মাত্র। কতটুকুই বা অভিজ্ঞতা ছিল বলুন? কিন্তু এখন আমার শরীর আঠেরোর হলেও আমার মনের বয়েস কিন্তু ছত্তিরিশ। আজ আমি জানি জীবন কতো দামী। আর কখনোই আমি প্রেমের জন্য মরতে পারব না!
A poor translation from Frank R. Stockton’s “The Bishop’s Ghost and The Printer’s Baby”
দোলা সেন

No comments: