বিশাল বিমানটা সোনাইকে নিয়ে দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টারম্যাক ছাড়িয়ে
ওপরে ওঠামাত্রই ব্যালকনিতে দাঁড়ান রোমির বুকের ভিতর থেকে একটি শব্দই বের হয়ে এল –
যাঃ। শরীরের ভিতর সুতীব্র যন্ত্রণায় শুরু হল এক অদৃশ্য রক্তক্ষরণ – ঠিক যেমন হয়েছিল
একুশ বছর আগে। যেদিন সোনাই তার নাড়ি ছিঁড়ে
বেরিয়ে এসেছিল বাইরের দুনিয়ায়।
অথচ এই তো ভবিতব্য ছিল। রেলিংটা ধরে নিজেকে সামলাতে সামলাতে আর ব্যথায় নীল
হয়ে ওঠা মুখটা আপ্রাণ চেষ্টায় সহজ করতে করতেই ভাবে রোমি। নয়মাস ধরে যখন তিলে
তিলে একটি প্রাণকে আকার দিচ্ছিল ও, তখন তো এরই প্রস্তুতি নিচ্ছিল দিন দিনে। শুধু
জানত না যন্ত্রণা এমন তীব্র হয়। অবশ্য তার সঙ্গে এটাও জানত না যে সেই যন্ত্রণার
ওপারে তার জন্য এক অফুরান আনন্দের খনি অপেক্ষা করে আছে – যার আলোয় তার বাকি জীবন
ভরে উঠবে। ছোট্ট পুটপুটে পুতুলটাকে যখন দেখল রোমি,কোন কষ্টের কথা মনেই রইল না তার।
ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট সোনাই বড় হল। তার খেলা, পড়া, দুষ্টুমির সবচেয়ে বড় সঙ্গী
ছিল তার মা – রোমি। হামা থেকে হাঁটা, অ-আ থেকে স্কুল, একসাথে মা- ছেলের বেড়ে ওঠা। এই
করে করে দশ বারোর গণ্ডী পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হোস্টেল। আজও মনে আছে রোমির,
সোনাইকে হোস্টেলে রেখে অটোতে ফিরছে হোটেলে, পাশে বসা একটি কুচকুচে কাল ছেলে তার
বান্ধবীকে ফোনে বিস্তারিত উপদেশ দিচ্ছিল – কি করে ফর্সা হতে হয়! মুখ ঘুরিয়ে মুচকি
হাসিটা শেয়ার করতে গিয়ে রোমির খেয়াল হল সোনাই তো পাশে নেই। এই না থাকাটা তাকে যত
না দুঃখিত করল, অবাক করল তার চেয়ে অনেক বেশী।
এই না থাকাটা ভাল করে অভ্যাস হবার আগেই চার বছরে অনেক পড়া খেলার দিন পেরিয়ে
সোনাই যেদিন বিদেশের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন পাঠনের সুযোগ পেল, সেদিন
আনন্দের সীমা ছিল না রোমির। সব ব্যবস্থা করেছে স্বামী স্ত্রী মিলে অপার উৎসাহে।
সোনাই তবু মাঝে মাঝেই বলেছে, তোমাদের ছেড়ে এতদূরে থাকব কি করে? হেসে উড়িয়েছে রোমি।
বুঝিয়েছে, আসল দূরত্ব হয় মনের। বলেছে, আজকের যোগাযোগের দুনিয়ায় ভৌগলিক দূরত্বের
কোন অর্থ নেই। এমনই শত কথায় শতবার ছেলেকে বুঝিয়েছে রোমি। শুধু নিজে যেটা বোঝেনি,
সেটা এই দ্বিতীয় বিচ্ছেদের যাতনাটুকু।
বিমান দৃষ্টির আড়াল হতে টলমল পায়ে
এগোতেই পাশ থেকে হাত ধরে অজয়। যে হাতটি তাকে এতদিন ধরে প্রতি মুহূর্তে সাথ
দিয়েছে, সোনাইয়ের প্রতি সাফল্যে যার নিঃসীম
সহযোগ না থাকলে রোমি বা সোনাই কেউ আজকের দিনে এত সহজে পৌঁছাতে পারত না – আজও সেই
হাত ধরে ফিরে চলে রোমি।
কি যে অদ্ভুত লাগছিল রোমির। যখন সে
ফিরে আসছিল তার পরিচিত আবাসে - নিত্যকার
পথের পরিচিত দৃশ্যের মাঝ দিয়ে – তখন তার মনে হল তার ছেলে এখন এক অতলান্ত মহাসমুদ্র
পাড়ি দিচ্ছে একলা। এমন এক দেশে যাচ্ছে সোনাই, যাকে রোমি দেখেনি কখনো, এমন এক ঘরে
গিয়ে উঠবে যে ঘরে তার পা পড়বে না – ততই এক পরম বিষ্ময়ে তার মন ভরে উঠছিল। ছেলের
প্রতি তার বিশ্বাস দৃঢ়তর হচ্ছিল ক্রমশ:। দুঃখ-যন্ত্রণার সমুদ্র সে পার হয়ে গেল
সেই পরম বিশ্বাসে। সারা মন জুড়ে রইল মায়ের মনের একান্ত প্রার্থনা – ভাল থাক, সুস্থ থাক। আজ তোকে
দিলাম এক আকাশ। যা আকাশটাকে ছুঁয়ে আয়।
No comments:
Post a Comment