বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা –
নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ হয়েই চলে বুকের
মাঝে, চোখের জল আগুন হয়ে ঝরে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয় – ওগো এভাবে আদর দিও না,
যত্ন করো না। আগাছাই যদি হয় তাকে তার মতো বাড়তে দাও – সবার সাথে লড়াই করে বাঁচতে
দাও।
দুদিনের
দেওয়া সার-জল ভালো করার চেয়ে মন্দ করে বেশি। কারো মাথায় হাত রাখার আগে পাঁচবার
ভাব, পাঁচদিন পরে হাত উঠিয়ে নেবে না তো? তুমি তো চলে যাবে আপন পথে, নিরবিচ্ছিন্ন
ব্যস্ততায়, আর সে?
তাই বলি দূরে থাকো এমন ভালোবাসা।
**
পর্ব-১
মিশা
মিশা এক ছোট্ট কালো ভালুকের নাম। তার
নিবাস ছিল কানাডার বানফে – সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। এখন কথা হল, পুঁচকে ভালুকছানা তার
মায়ের সাথে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার নাম দিতে গেল কে, আর দিলই বা কেন?
আসলে হয়েছিল কি, এই ছোট্ট ছানাটি –
তখনো তার কোনো নামকরণ হয় নি – ছিল ভারি দস্যি।তার মা যতই চোখ পাকাক, বকুনি দিক
একুশবার – সে কিছুতেই তা শোনার পাত্র নয়। ভাইবোনেরা যখন ওর মার পিছনে গুড়গুড়িয়ে
যায়, সে তখন ছুট দেয় রঙিন প্রজাপতির পিছনে, কিংবা তাড়া লাগায় খয়েরী খরগোশগুলোকে।
হামেশাই দলছুট হয়ে চ্যাঁ ভ্যাঁ জোড়ে, আর তাই শুনে তার মা দৌড়ে আসে, ঘাড় ধরে নিয়ে
যায় নিরাপদ আশ্রয়ে।
এভাবেই দিন দিন সাহস বাড়ছিল বাচ্চাটার।
সেদিন তাই একটু বেশি দূরেই গিয়ে পড়েছিল।ফেরার পথটা আর খুঁজে পাচ্ছিল না ও।আর
অনেকটা দূরে চলে আসার জন্যই বোধকরি ওর মাও অন্যদিনের মতো ওকে খুঁজে পায় নি।
ঘোরাঘুরি, খেলাধুলো মাথায় উঠেছে, খিদে,
তেষ্টায় ভয়ে ভালুকছানা তখন আধমরা। এদিক যায়, ওদিক ছোটে, কুঁই কুঁই করে কাঁদে। এমনই
ছুটতে ছুটতে, ঘুরতে ঘুরতে একসময় কিভাবে যেন চলে এল পাকা রাস্তার ধারে। শাঁই শাঁই
আওয়াজ করে গোল গোল পায়ে কত কত জন্তু ছুটে যাচ্ছে সে পথ ধরে! ভয়ের চোটে রাস্তার
ধারের ঝোপটার আড়ালে মুখ লুকিয়ে সে কাঁদতে লাগল।
সেই রাস্তায় গাড়ী করে আরও অনেক
ট্যুরিস্টের মতো চলছিল এক চীনে পরিবার। তাদের নজর পড়ল ভয় আর ক্লান্তিতে প্রায়
অর্ধমৃত ভালুকছানাটির ওপর। বড্ডো মায়া হল। ভুলে গেল, গেম ওয়ার্ডেনের সতর্কবাণী –
কখনো কোনো অবস্থাতেই বন্যপ্রাণী ছোঁওয়া বা তাকে খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ। কোলে করে
তুলে আনল শিশুটিকে। জল খাওয়ালো আর খেতে দিল আপেল। তারপর তাকে নিয়ে গেল ভিজিটর
সেন্টারে জমা দেবার জন্য। তাদের রিপোর্ট না করে নিজেরা বাচ্চাটিকে তুলে আনার জন্য কর্মীরা
তো রেগে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে ওদের নিয়ে দৌড়ল
সেই জায়গাটি চিহ্নিত করতে। কিন্তু বনের রাস্তার ধার সবই তো একরকম। তাই অনেক খুঁজেও
কোন ফল হল না। চীনে দম্পতির মোটা টাকা ফাইন হল।
তারপর আর কি? রোজ সকালে ওয়ার্ডেনরা
বাচ্চাটিকে সাম্ভাব্য নানা জায়গায রেখে আসে, কিন্তু দু একদিন পরে ফিরিয়ে আনতে হয়।
কে জানে, মানুষের গন্ধ ওর শরীরে লেগে গিয়েছিল বলেই হয়ত ওকে কেউ গ্রহণ করল না!
অগত্যা বনবিভাগের কর্মীরা ওকে বন্যজীবনে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। ওর নামকরণও
হল – মিশা।
কিন্তু এর মধ্যে ঘটে যাচ্ছে আর এক
অভিযোজন। মানুষের সাথে থেকে থেকে মিশার মন
থেকে মানুষের প্রতি ভয় চলে যাচ্ছে। তার মতো চঞ্চল শিশু একজায়গায় স্থির হয়ে থাকার
পাত্র নয়। সে এর মধ্যেই এর ওর ব্যাগ হাতড়ে খেয়ে ফেলেছে বিস্কুট, কেক, চকোলেট।
মিশার ধারণায় জঙ্গলের বেরির চেয়ে এরা অনেক সহজলভ্য ও সুস্বাদু। অতএব বনে ছেড়ে এলে
হবে কি, মিশা শেষমেশ আস্তানা গাড়ল এক লোকালয়ের কাছেই। রাত হলেই বের হয, রান্নাঘর
থেকে চুরি করে নিয়ে আসে নানান খাবার। তুলতুলে ভালুকটাকে নিয়ে মজা করে সবাই, ভালোও
বাসে।
সমস্যা হল মিশা একটু বড় হতেই। বয়েসে
ছোট হলে কি হবে, প্রজাতিগতভাবে সে শক্তিতে এবং চেহারায় বেশ বড়। ফলে এখন তার হাতের
ধাক্কায় জানলার কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। ফ্রিজ খুলতে বাধা দিতে গেলে ঠেলা খেয়ে
লোকজন উল্টে পড়ে।একদিন তো এক দুর্ঘটনাই ঘটে গেল। মিশার ঠেলায় পড়ে গিয়ে এক বৃদ্ধার
মাথাা টেবিলের কোণায় ঠুকে ফেটে গেল। তাঁর আর্তনাদে নাকি রক্ত দেখে – কে জানে, ভয়
পেয়ে মিশা তাড়তাড়ি ওনার মুখ চেপে ধরল। দমবন্ধ হয়ে মারা গেলেন বৃদ্ধা।
মিশাকে আসেপাশের লোকজনেরা ভালোবাসত
বলেই তার নামে এতদিন রিপোর্ট করেনি কেউ। কিন্তু এবার তো আর উপায় নেই। পুলিসে খবর
দেওয়া হল। কানাডার আইন অনুযায়ী কোনো বন্যপ্রাণী মানুষ মারলে তার শাস্তি মৃত্যু।
এরপর কিছুদিন ধরে এলাকার
রেস্তোরাগুলিতে একটি মহার্ঘ্য পদ পরিবেশিত হল – BEAR BURGER!
****
পর্ব – ২
ঝরাপাতা
কেন যে পেকুর নাম
ঝরাপাতা রেখেছিল আঁকিয়ে দাদাবাবু, তা কে জানে! অবশ্য তার পেকু নামটাও যে কার দেওয়া
তাও তো সে জানে না। সেই কোন ছোটবেলায় বাপ-মা মরে গেছে – কাকা কাকীর কাছেই মানুষ।
অবশ্য একে যদি মানুষ হওয়া বলা যায়! সারাদিন পেটকোঁচড়ে মুড়ি বেঁধে নদীর ধারে ছাগল
চরায়। এছাড়া এর ওর বাগানের ফলপাকুড় ভরসা। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরলে ভাত খেতে পায়। এই
জীবন নিয়ে পেকুর অবশ্য কোনো অভিযোগও নেই। ও মেনে নিয়েছে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
পেকুর বাবা মা নেই, তাই ও সকালে কাকীর হাতে হাতে বাসী কাজ সেরে দিয়ে, পান্তা খেয়ে,
কোঁচড়ে মুড়ি বেঁধে ছাগল চরাতে যায়, আর নীলু, টুসির মা আছে বলে ওরা দুধ-চিঁড়ে খেয়ে
ব্যাগ কাঁধে ইস্কুলে যায়। এ ব্যবস্থায়
বেশ খুশিই ছিল পেকু। এমনকি যেদিন বকুনি বা মারের বদলে রাতে ডালভাতের সাথে সব্জিও
জুটে যেত, সেদিনটার খুশির চাটনি বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সামনের বেশ কটা দিন
ধরে।
এই দাদাবাবুটা এসে সব
হিসেব পাল্টে দিল। শিলিগুড়িতে থাকে বলেছিল। শিলিগুড়ি আবার কি? ইলশেগুড়ি জানে পেকু।
সেই ঝিরিঝিরিতে ভিজতেও ভারি মজা। কিন্তু শিলিগুড়ি? সে এক মজার শহর নাকি! সেখানে
আছে ইয়াব্বড়ো বড় বাড়ি, আর অনেক গাড়ি। সেখানে লোকে রিক্সা টানে আর যেই লালবাতি
জ্বলে ওম্নি সবকটা গাড়ি থেমে যায়, আর রিক্সাগুলো এ ওর পিছনে ঠকঠকাঠক ঠুকে থেমে
যায়। ছবি এঁকে পেকুকে দেখিয়েছিল আঁকিয়ে দাদাবাবু। পেকু তো হেসেই বাঁচে না!
এই দাদাবাবুর নাম রণি।
সে নাকি শুধু ছবি আঁকতেই এসেছে তাদের গাঁয়ে। নদীর ধারে যেখানে ও ছাগল চরায়,
সেখানেই বটগাছতলায় বসে ছবি আঁকে। তারও ছবি এঁকেছে দাদাবাবুটা। সেই থেকেই আলাপ,
গল্প। একদিন এইসব কথার মাঝেই বটগাছ থেকে একটা পাতা খসে এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছিল –
তাই দেখে রণি দাদাবাবুর কি মনে হল কে জানে, তার নাম দিল ঝরাপাতা।
তা দাদাবাবু তাকে কৌটো
খুলে খাবারের ভাগ দেয়, বদলে পেকু তাকে এনে দেয় মিষ্টি জাম, আতা, পেয়ারা। একদিন একটুকরো
চৌকো বাদামী মতো কি একটা দিয়েছিল, অতো ভালো মিষ্টি পেকু জীবনেও খায় নি।আর দাদাবাবু
যখন ওর এলোমেলো চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বলে, -‘চুলটাও আঁচড়াতে পারিস না?’ – তখন এক
অনস্বাদিত আনন্দে পেকুর নাকি ঝরাপাতার মনটা ভরে ওঠে। কোনদিন যে তাকে কেউ এটুকু
আদরও করেনি!
কিছুদিন বাদে রণি
দাদাবাবু চলে গেল। যাবার আগে একটা কাগজে ওর নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে বলে গেল – “দরকার
হলে কাউকে দিয়ে একটা চিঠি লেখাস রে ঝরাপাতা। আর এই টাকাটা রাখ। কখনো তোর কাজে
লাগবে।“
দাদাবাবু চলে যাবার
পরের দিনগুলো ভারি হতে হতে ক্রমশঃ পিষে ফেলতে লাগল পেকুকে। আদর আর ভালোবাসার স্বাদ
পায়নি যখন, তখন অনাদর তার অসহ্য হয়ে ওঠে নি। ডালভাতের মতই সেগুলোও নির্বিকারভাবেই
গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু এখন কাকীর গঞ্জনা, ভাইবোনদের ঠাট্টা – তার চামড়া ছাড়িয়ে
ভিতরে আঘাত করে। অবুঝ অভিমানে দুচোখ বেয়ে জল গড়ায়। ছাগল চরাতে গিয়ে বটগাছতলায় যেখানে
তার দাদাবাবু বসত, সেখানে গড়গড়ি দিয়ে কাঁদে।
এমনই এক মন খারাপের
দিনে পেকুর নাকি ঝরাপাতার মনে পড়ল ঠিকানা লেখা সেই কাগজটার কথা। সে জানে, ঠিকানা
লেখা থাকলে যেমন কোন লোককে চিঠি লেখা যায়, তেমনই সেই লোকের কাছেও পৌঁছানো যায়। সে
আরও জানে বিষ্যুৎবারে গঞ্জে যেখানে হাট বসে, তার পাশেই বাস ডিপো। সেখান থেকে
শিলিগুড়ির বাস ছাড়ে। রণি দাদাবাবু ওই বাসে করেই তো এখনে এসেছিল।
সবার চোখ এড়িয়ে এক
কুয়াশামাখা ভোরের আধো আলোয় সে গঞ্জের পথে রওনা দিল। কাকার সাথে হাটে গিয়ে গিয়ে এ
রাস্তা তার চেনা। কন্ডাকটরকে জিজ্ঞাসা করে সে শিলিগুড়িগামী বাসে উঠে দাদাবাবুর টাকা দিয়ে বাসের টিকিট কাটল। জানলার
ধারের সীটে বসে এতক্ষণে সে ভারি খুশি হয়ে উঠল। এবার সে চলে যাবে তার প্রিয়
দাদাবাবুর কাছে। তাদের বাড়ির সব কাজ সে করে দেবে। তাহলেই তারা তাকে থাকতে দেবে।
তাকে ভালোবাসবে। দাদাবাবুর মতো তার বাড়ির লোকজনও খুব ভালো। সে গল্প শুনেছে কত! বাস
ছেড়ে দিল। সকালের হাওয়া তার মাথায় খেলা করতে লাগল। এবার তার বড় ঘুম পাচ্ছে।
ঠিকানার কাগজটা বুকে জড়িয়ে ধরে সে চোখ বুজল।
নদীতীরের বটগাছটির
ডালপালা সেই হাওয়ায় শিউরে কেঁপে উঠল। একটা পাতা টুপ করে খসে পড়ল নদীর জলে। ঢেউয়ের
মাথায় চড়ে নাচতে নাচতে কোথায় যে ভেসে গেল কে জানে!
মাথা নাড়তে থাকে বুড়ো
গাছ – “ক্ষণিকের ভালোবাসার শেষ ভালো হয় না গো। না হয় দূরেই থাক এই ভালোবাসা। “
কেউ কি শুনল? কেউ কি
শোনে? কে জানে?
No comments:
Post a Comment