অহল্যা দ্রৌপদী
কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা
স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম॥
*
কথা হচ্ছিল প্রাতঃস্মরণীয়া পাঁচজন
মেয়ের। ভোরবেলায় যাঁদের নাম করলে মহাপাপও বিনাশ হয়। কিন্তু যাঁদের মতো হতে বলেন না
কোন আশীর্বাদকই। এই বৈপরীত্যই বারে বারে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে মহাভারতের
মহাসমুদ্রে। প্রতীক ছেড়ে সহজভাবে খুঁজে বেরিয়েছি তাঁদের মানবী সত্ত্বাকে। জানতে
চেয়েছি কোন অপরূপ চরিত্রবলে এঁরা সেই পুরুষপ্রধান যুগেও আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর
ছিলেন।
তাঁদের চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য ঢাকতে বারে বারে অবতারণা করা হয়েছে রূপকের। কখনো কৃষিসভ্যতার আড়ালে রূপকের জালে তাঁদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কখনো বা পঞ্চেন্দ্রিয়-দেহ আত্মা ইত্যাদির দৈবী বাতাবরণে তাঁদের মাথায় পরানো হয়েছে অলৌকিক মুকুট। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না – যা নাই ‘ভারতে’ তা নাই ভারতে! প্রথম ভারত মানে মহাভারত। তাই তৎকালীন সমাজের এক সংগ্রামী নারী – যিনি বারবার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর রাজনৈতিক সচেতনতায় উল্টে দিয়েছেন ভাগ্যের হিসাব, যাঁর চরিত্রে মহানতার সাথে মিশে থাকে কিছু স্বার্থান্ধতা, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয় আবেগ ও মমতা – এবং তারপরেও আমাদের কাছে যাঁর প্রধান পরিচয় একজন জননী – সেই কুন্তীর কথা হোক আজকের আলোয়।
তাঁদের চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য ঢাকতে বারে বারে অবতারণা করা হয়েছে রূপকের। কখনো কৃষিসভ্যতার আড়ালে রূপকের জালে তাঁদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কখনো বা পঞ্চেন্দ্রিয়-দেহ আত্মা ইত্যাদির দৈবী বাতাবরণে তাঁদের মাথায় পরানো হয়েছে অলৌকিক মুকুট। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না – যা নাই ‘ভারতে’ তা নাই ভারতে! প্রথম ভারত মানে মহাভারত। তাই তৎকালীন সমাজের এক সংগ্রামী নারী – যিনি বারবার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর রাজনৈতিক সচেতনতায় উল্টে দিয়েছেন ভাগ্যের হিসাব, যাঁর চরিত্রে মহানতার সাথে মিশে থাকে কিছু স্বার্থান্ধতা, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয় আবেগ ও মমতা – এবং তারপরেও আমাদের কাছে যাঁর প্রধান পরিচয় একজন জননী – সেই কুন্তীর কথা হোক আজকের আলোয়।
|| কুন্তী
||
যাদব বংশের রাজা শূরসেন। পুত্রলাভ
উপলক্ষ্যে তাঁর ঘরে আজ মস্তবড় উৎসব। তাঁর একটি সুলক্ষণা শান্ত সুন্দরী মেয়ে আছে
বটে, কিন্তু বংশরক্ষা তো আর কন্যা দিয়ে হয় না! পুত্রলাভে তাই আজ তাঁর আনন্দের সীমা
নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা এসেছেন, এই আনন্দের ভাগীদার হতে।
রাজ্যময় আনন্দের মাঝে একটি মুখ শুধু মলিন। সেই মুখ শূরসেনের ভাগ্নের। নামেই
ভাগ্নে, সমবয়েসী দুটি মানুষের মধ্যে আসল সম্পর্কটা গভীর বন্ধুত্বের।
এই ভাগ্নেটি নিঃসন্তান। তাই বন্ধুত্বের
কোন এক আবেগঘন মুহূর্তে শূরসেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর একটি সন্তান তিনি একে দান
করবেন। তারপর কালের নিয়মে বহু সময় পেরিয়ে গেছে। প্রথম সন্তানের মুখ দেখেছিলেন যখন,
তখন এই শপথের কথা তাঁর মনেও ছিল না। কিন্তু আজ এই পুত্রলাভের আনন্দঘন মুহূর্তে
ভাগ্নের মলিন মুখটি তাঁকে পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কিংবা এমনও হতে
পারে ছেলে পাবার আনন্দে মেয়েটির গুরুত্ব তাঁর কাছে কমে গিয়েছিল। তা সে যে কারণেই
হোক, শূরসেন সর্বসমক্ষে তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করলেন এবং সভামাঝেই
ভাগ্নের হাতে কন্যাটিকে দান করলেন। সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
এই মেয়ের নাম পৃথা। ভাগ্নের নাম রাজা
কুন্তীভোজ, আর যে পুত্রলাভের জন্য এই উৎসব – তার নাম বসুদেব। বসুদেবের পুত্র
যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য পরে বহুবার এই পিতৃস্বসার পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।
কুন্তীভোজের অবস্থা হল আনেকটা সামনে
পাহাড় আর পিছনে খাদে আটকে যাওয়া প্রাণীর মতো। যখন এই প্রতিজ্ঞা, তখন তাঁর মনের কোণে
কোথাও কন্যালাভের বাসনা ছিল না। তাই আজ যখন বসুদেবের বদলে পৃথাকে দান করলেন
শূরসেন, তখন তিনি মনে মনে ভারি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। এদিকে শূরসেন অত্যন্ত শক্তিশালী
রাজা। আর এই মুহূর্তে তাঁর এই মহান দানের স্তুতিগানে সমগ্র যাদবকুল যেভাবে মেতে
উঠেছে, তাতে প্রতিবাদের ফল যে কোনদিক দিয়েই ভালো হবে না – সেটুকু না বোঝার মতো
কাঁচা রাজনীতিবিদ কুন্তীভোজ
নন। কাজেই
মনে যাই থাক, হাসিমুখেই পৃথাকে গ্রহণ করলেন তিনি। নতুন পিতার নামে তাঁর নতুন
নামকরণ হল – কুন্তী। ছোট মেয়েটি কিছু বোঝার আগেই বদলে গেল তার বাবা-মা-ঘর-গোত্র
সব, সবকিছু। শূরসেন কন্যাদায় থেকে মুক্ত হলেন, আর কুন্তীভোজ অপ্রসন্ন মনে সেই দায়
নিয়ে ঘরে ফিরলেন।
শূরসেনদত্ত কন্যা – তাকে আর যাই হোক
অবহেলা করা যায় না। তাই তার জন্য তৈরি হল আলাদা মহল। সেখানে ধাত্রীমাতা ও দাসী
পরিবৃত হয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন কুন্তী। হয়ত দাসীসংসর্গের জন্যই তিনি রাজকন্যাসুলভ
ঔদ্ধত্য অর্জন না করে এক নরম সেবাপরায়ণা নারী হয়ে বেড়ে উঠছিলেন। রাজপ্রাসাদে তো
সমানেই বহু মুনি ঋষির আনাগোনা – তা কুন্তীভোজের মনে হল, খাইয়ে দাইয়ে মেয়েটাকে বড়
করছেন যখন, তখন তো তাঁদের সেবায় কুন্তীকে নিয়োজিত করাই যায়! রাজকন্যার সেবায় তুষ্ট
মুনিদের আশীর্বাদে রাজার যশ ও পুণ্য দুইই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। কিশোরী কুন্তীর
খেলধূলার দিন গেল। ছোট মেয়েটি তাতে দুঃখ পেয়েছিল নাকি বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসতে
পেরে খুশি হয়েছিল তা ঠিকমতো জানা যায় না। জন্ম থেকেই
তিনি পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত – নিজের মনে নিজেকে গুটিয়ে রাখা তাঁর অভ্যাসে পরিণত
হয়েছে।
তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুনি ঋষিরা
আসেন। তাঁদের কেউ সৌম্য, কেউ ক্রোধী, আবার কেউ বা স্নেহপরায়ণ। তাঁরা সকলেই এই
মেয়ের সেবায় মুগ্ধ, চমৎকৃত। তাঁদের কাছে নানা ধর্মকথা, রীতিনীতি, উপদেশ শুনতে
শুনতে বড় হয়ে ওঠেন কুন্তী, মননে ঋদ্ধ হন।
তাঁর সেবা আর মধুর ব্যবহারের খ্যাতি পল্লবিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে তা
একদিন মহর্ষি দুর্বাসার কানে পৌঁছায়।
সদা অসন্তুষ্ট কোপনস্বভাব এই তপস্বী
সর্বদাই অপরের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত থাকেন। হয়ত কোন অপ্রাপ্তি তাড়া করে বেড়ায়
তাঁকে। কঠোর তপস্যা তাঁকে সিদ্ধ করেছে। তিনি
ত্রিলোকের ভক্তি, সমীহা আর ভয়ের পাত্র। কিন্তু ভালোবাসা? কই সেরকম কিছু তো জমা হয়
নি তাঁর ঝুলিতে! তাই কাউকে তা পেতে দেখলেই রাগে অস্থির হয়ে ওঠেন, তাঁর ত্রুটি
আবিষ্কার করে অভিশাপ না দেওয়া পর্যন্ত শান্ত হন না। সেই দুর্বাসা কুন্তীর এত
প্রশংসা শোনার পরেও পরীক্ষা নিতে আসবেন না, সে কি হয়?
দুর্বাসার এই আগমনের সংবাদে
কুন্তীভোজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঋষিবর ক্রুদ্ধ হলে তাঁর রাজ্যের সমূহ সর্বনাশ।
তাই তিনি তড়িঘড়ি কুন্তীর কাছে এলেন, স্নেহবচনে তাঁকে অভিষিক্ত করে দুর্বাসার আগমন
এবং উদ্দেশ্য জানালেন।
মনে মনে হাসলেন কুন্তী। দুর্বাসার নানা
উপাখ্যান তিনি নানা মুনির কাছে শুনেছেন। তিনি জানেন ঋষির রোষের ভয়ই পিতাকে আজ
প্রার্থীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবু এই তাঁর জীবনে প্রথম পাওয়া পিতার
স্নেহবচন! তার দাম দেবেন না কুন্তী? তাও কি হয়? তিনি মধুর বচনে কুন্তীভোজকে
আশ্বস্ত করলেন – পিতা, আপনি আমায় পালন করেছেন। আপনার কোন ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি
না। আপনি নিশ্চিন্ত ও
নির্ভয় হোন, ঋষিকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব আমার।
নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন কুন্তীভোজ।
একবারও ভেবে দেখলেন না কি অসম্ভব এক গুরুদায়িত্ব তিনি তাঁর কন্যার উপর চাপিয়ে দিয়ে
গেলেন।
দুর্বাসা এলেন কুন্তীর ভবনে। আর
আক্ষরিক অর্থেই অতন্দ্র সেবায় নিয়োজিত হলেন পৃথা। দাসীদের ভরসা করতে পারেন না। একা
হাতে সব কাজ করেন। আর ছটফট করতে থাকেন সেই মহাঋষি। কিছুতেই যে তিনি কোন ত্রুটি
খুঁজে পাচ্ছেন নে যার জন্য অভিশপ্ত করে দেওয়া যায় এই নারীর জীবন! গভীর রাত হোক বা
দিবা দ্বিপ্রহর, যখন যা আদেশ করছেন ঋষি, হাসিমুখে মুহূর্তমধ্যে তাই পালন করছেন
পৃথা। অবাক হন ঋষি। এক মমতাও কি কাজ করে ভিতর ভিতর? নাহলে কেনই বা তিনি পৃথাকে
শোনান নানা শাস্ত্রের কথা,সমাজের রীতি, রাজনীতির কথা? কুন্তীকে তিনি গড়ে তোলেন আগামী জীবনের উপযুক্ত করে। বৎসর
অতিক্রান্ত হল। তুষ্ট হয়েছেন দুর্বাসা, যাবার আগে বর দিয়ে যাবেন মেয়েটিকে। কিন্তু
তার আগে শেষ পরীক্ষা করে দেখে নেবেন এই মেয়ে সেই বরের উপযুক্ত কিনা।
ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নানে গেলেন দুর্বাসা। ফিরে এসেই নাকি সদ্যপ্রস্তুত অন্ন চাই তাঁর! কুন্তী
তাঁর অভ্যস্ত দ্রুততায় রান্না নিয়ে ঘরে এলেন যখন, তখনই ঘরে ঢুকছেন মহর্ষি। প্রণতা
মেয়েটিকে ওঠার মুখে বাধা দিলেন ঋষি। তাঁর পিঠের উপর রাখলেন সদ্যপ্রস্তুত খাদ্য। পিঠ
পুড়ে গেল তাপে, তবু একবছর যে মেয়েটি অনিদ্রা ও প্রায় অনাহারে কাটিয়েছে, আজও তার
ধৈর্যচ্যুতি হল না। বেদনার সামান্যতম কম্পনকেও সে বাইরে আসতে দিল না! তুষ্ট হলেন
দুর্বাসা। সহনের
এই চূড়ান্ত রূপই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বচনে কুন্তীর দহনজ্বালা প্রশমিত
হল।
পৃথার কানে তিনি দিলেন এক মন্ত্র। সেই মন্ত্রে যে দেবতাকেই আবাহন করবেন কুন্তী
তিনি এসে কুন্তীর বাসনাপূর্ণ করবেন।
চলে গেলেন দুর্বাসা। কিন্তু ছোট থেকে
যে বড় হয়েছে দাসীমহলে আর পুরুষ বলতে একমাত্র দেখেছে জিতেন্দ্রিয় তপস্বীদের, সেই
সদ্যতরুণীর পক্ষে এই বরের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব ছিল না। শিশুর হাতে নতুন
খেলনা এলে সে যেমন সেটিকে নানাভাবে নেড়েচেড়ে ঠুকেঠাকে দেখতে থাকে, কুন্তীর অবস্থা
হল অনেকটা সেইরকম।
এইরকমই এক দিনে সে প্রাসাদের লাগোয়া
নদীতীরে স্নান সেরে ওঠার সময় তার চোখ পড়ল সদ্যোত্থিত দিবাকরের দিকে। কি জানি কী
ছিল সেই সকালের আলোয়, জলের ঝিলিমিলিতে, কিংবা পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় –
পৃথার চোখ আর দিবাকরের ওপর থেকে সরল না। তার মুগ্ধ হৃদয় চাইল, এই অর্কপ্রভকে কাছে
পেতে, তার মুখ থেকে দুটি কথা শুনতে। তাই সে মন্ত্রোচ্চারণ করে দিবাকরকে আহ্বান
করল। এলেন সেই তেজোময় পুরুষ, জানতে চাইলেন কী তার প্রার্থনা। “কী চাই?” – তা তো
জানে না পৃথা। তার তো শুধু দেখে ভালো লেগেছিল, একটু কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। তার
ইচ্ছেপূরণ হয়ে গেছে, এবার সে দিবাকর এবং দুর্বাসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যেতে চায়
তার আপন ঘরে। হাসলেন দিবাকর। তিনি জানেন, কিশোরী পৃথার মধ্যে এক নারী জন্ম নিচ্ছে –
সে এখনো তাকে চেনে না। একে পরিণত করতে হবে তাঁকেই। ঋষির বরকে পুরো সার্থক না করে
তাঁরও তো আর ফিরে যাবার উপায় নেই! তিনি বালিকাকে বোঝালেন এই আবাহনের প্রকৃত অর্থ।
বড় যত্নে বড় সাবধানে দিবাকর পৃথাকে দিলেন নারীত্বের প্রথম স্বাদ। তৃপ্ত হয়ে ফিরে
গেলেন দিবাকর। আর ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
আর জীবনের প্রথম অবুঝ ইচ্ছের দাম
চুকিয়ে ঘরে ফিরে এলেন পৃথা। এরপর মাসের আবর্তনছন্দে ছেদ পড়তেই ধাইমার ভ্রুকুটি। কিন্তু সব শুনে মাথা চাপড়ে হায় হায় করা ছাড়া
আর কিই বা করতে পারেন তিনি। সবদিক বজায় রাখতে গেলে যা করা যায় সেটাই করলেন। পৃথাকে লোকচক্ষু থেকে গোপন রাখলেন। ন
মাস পরে দিব্য কবচ-কুণ্ডলধারী এক উজ্জ্বল শিশুর জন্ম হল। কিন্তু সে যে কানীন। আর
পৃথা যে কত একা, কত অসহায় সেকথা ধাইমার চেয়ে বেশি কে জানে? তাই শিশুটিকে এক ডালায়
রেখে, আর এক ভোরের আলোয় সেই দিবাকরকে আর ধাইমাকে সাক্ষী রেখে চোখের জলে ভেসে প্রথম
সন্তানকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে দিতে পৃথা একমুহূর্তে জীবনের অনেকগুলো ধাপ এক
নিমেষে পার করে গেল। নরম মনের মেয়েটা ধীরে ধীরে পালটে যেতে লাগল – সে বুঝে গেল
জীবনভোর তাকে একলা চলতে হবে। নিজের বা আপনজনের স্বার্থরক্ষায় তাকে কখনো ক্ষুদ্র,
কখনো মহৎ আবার কখনো বা নিষ্ঠুর হতে হবে। এই তার নিয়তি। জীবন তাকে এভাবেই খেলায়
নামিয়েছে।
এসব কথার আভাস কুন্তীভোজের কানে
পৌঁছেছিল কিনা কে জানে, কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তিনি কুন্তীর স্বয়ম্বরসভা
আহ্বান করলেন। কুন্তী হলেন কুরুকুলবধু – রাজা পাণ্ডুর স্ত্রী। এখানেও কুন্তীর জন্য
কোন সরল জীবন অপেক্ষা করে নেই। বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। তাই ছোটভাই পাণ্ডু
রাজা হয়েছেন। রাজনীতির এক জটিল সমস্যার
সূত্রপাত এখান থেকেই। এবার দুভাইয়ের মধ্যে যাঁর সন্তান আগে জন্মাবে সেই
রাজ্যাধিকারী। কাজেই পুত্রলাভের তাগাদা দুজনের মধ্যেই থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
কাজেই পাণ্ডু দ্বিতীয় বিবাহ করে ফেললেন মদ্ররাজকন্যা মাদ্রীকে।
এদিকে জন্মগতভাবেই দুর্বল পাণ্ডু। তার
পাণ্ডুর বর্ণ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। এর উপর তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে সঙ্গমরত এক
হরিণদম্পতিকে হত্যা করে বসলেন! একে তো সঙ্গমরত প্রাণীকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ,
তার উপর আবার এরা সাধারণ মৃগ ছিল না। এক ঋষিদম্পতি হরিণরূপে নিজেদের দাম্পত্য
উপভোগ করছিলেন। মরবার আগে তারা অভিশাপ দিয়ে গেলেন – পাণডু আর কোনোদিনও কোন রমণীতে
উপগত হতে পারবেন না। হলে নিশ্চিত মৃত্যু।
হতাশ পাণ্ডু রাজধানীতে ফিরে পত্নীদের
সবকথা খুলে বললেন। কুন্তী এখন অনেক পরিণত। জীবন তাঁকে অনেক বিরুদ্ধ পরিস্থিতির
মোকাবিলা করতে শিখিয়েছে। তিনি স্বামীকে বনবাসী হবার পরমর্শ দিলেন। তিনি জানেন
রাজমাতা হবার এই একমাত্র পথ। অভিশপ্ত পাণ্ডুর এমনিতেই আর কিছু ভালো লাগছিল না।
তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে সামনে রেখে রাজ্যের দায়িত্ব নিলেন সেই পিতামহ
ভীষ্ম। ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে খুশিই হলেন। কারণ গান্ধারী তখন সন্তানসম্ভবা। তাহলে
তাঁর ছেলেই হবে হস্তিনাপুরের রাজা। বেদব্যাস নিজে বর দিয়েছেন তাঁর শতপুত্র হবে।
কিন্তু কোন অজানা কারণে এই গর্ভধারণকাল খুবই দীর্ঘ। এদিকে বনে গিয়েই কুন্তী স্বামীকে
দুর্বাসার বরের কথা জানালেন। অবশ্যই কর্ণের কথা গোপন করে। উল্লসিত হয়ে উঠলেন
পাণ্ডু। তিনি জানেন ক্ষেত্রজ পুত্র সংসারে স্বীকৃত এবং বৈধ। এমন কি তাঁরা দুভাইও
তো......
তিনি কুন্তীকে বললেন একজন সত্যবাক,
ন্যায়পরায়ণ এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন দেবতাকে আহ্বান করতে, যাতে ছেলেও একজন মহান রাজার
সবগুণ নিয়ে জন্মায়। কুন্তী অনেক ভেবে আহ্বান করলেন ধর্মরাজ যমকে। জন্ম হল দ্বাপরের
শ্রেষ্ঠ ধার্মিক পুরুষ যুধিষ্ঠিরের! বনের এ খবর হস্তিনাপুরেও এসে পৌঁছাল।
গান্ধারীর তখনও প্রসব হয় নি। মনের দুঃখে তিনি নিজের পেটে আঘাত করে গর্ভপাত করালেন।
কিন্তু ব্যাসদেব সেই অপরিণত মাংসখণ্ড ১০১ ভাগে ভাগ করে মাটির হাঁড়িতে রাখলেন।
পাণ্ডু পুত্র পেলেন বটে, কিন্তু তাঁর
মন ভরল না। তিনি নিজে দুর্বল, তাই শান্ত ধীর স্বভাবের ছেলেকে পছন্দ হল না তাঁর।
একজন যখন হয়েছে, তখন আরও একজন কেন নয়? তাই বলবান পুত্রের কামনায় কুন্তী এবার
আহ্বান করলেন পবনদেবকে। জন্ম হল ভীমের। সেই সময় একে একে মাটির কলসীতে রাখা
মাংসপিণ্ডেরা প্রাণ পেতে আরম্ভ করেছে। প্রথম জন্ম দুর্যোধনের।
পাণ্ডু প্রথমে ভীমকে দেখে খুশি হয়ে
উঠলেও শিগগিরই বুঝতে পারলেন এ ছেলে সরল আর গোঁয়ার। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝা তার সাধ্যাতীত। অতএব আবার একবার। বহু
চিন্তার পরে নির্বাচিত হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। অর্জুনকে পেয়ে তুষ্ট হলেন পাণ্ডু।
কিন্তু এদিকে কুন্তীকে দেখে মাদ্রীরও মা হবার বাসনা জেগে উঠল। তিনি ধরে পড়লেন
পাণ্ডুকে। স্বামীর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না কুন্তী। তিনি মাদ্রীকে একবারের জন্য
মন্ত্রদানে সম্মত হলেন। এইখানে মাদ্রী একটা চালাকি করলেন। তিনি স্মরণ করলেন
অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে।
নকুল ও সহদেব নামে যমজ ছেলে হল তাঁর। কুন্তী
মনে মনে চটলেও তাঁর আর কিছু করার ছিল না।
এর কিছুদিন পরে পাণ্ডুর মৃত্যু এবং
মাদ্রীর সহমরণে কুন্তী পাঁচ ছেলে নিয়ে আবার একা। কিন্তু রাজনীতি অভিজ্ঞা এই নারী
জানেন হস্তিনাপুর এই শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।
তাই তিনি বনেই থেকে গেলেন। আর মুনি ঋষিদের সেবা করে তাঁদের বিশ্বাস আর সহানুভূতি
অর্জন করলেন। তাঁর প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতাও তাঁকে সাহায্য করেছিল বৈকি। এরপরে ছেলেরা
একটু বড় হলে মুনি ঋষিদের সঙ্গে পাঁচ ছেলে নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন কুন্তী।
মুনিদের সাক্ষ্যে পঞ্চপাণ্ডবের জন্মবৃত্তান্ত এবং যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব প্রমাণিত
হল। যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব প্রমাণ হবার অর্থ হল রাজ্যের উত্তরাধিকারের দাবী। এতদিন
ধরে যে সিংহাসন নিজের বলে জেনে এসেছেন দুর্যোধন, তাঁর পক্ষে এই পরিবর্তন কাম্য নয়
মোটেই। তদুপরি তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসজাত, আর পাণ্ডবরা ক্ষেত্রজ। দুর্যোধনের বিচারে
তাই কৌন্তেয়রা পাণ্ডব নন। সিংহাসনের দাবী
তাঁদের থাকতেই পারে না। এই সময়ে অবশ্য তিনি সুবিধাজনকভাবে ভুলে যান তাঁর পিতার
জন্মকথা।
যাই হোক, কুন্তী তো জানতেনই যে এমনটাই
হবে। প্রখর বুদ্ধিশালিনী এই রমণী বললেন – ছেলেরা সবাই তো এখন অনেক ছোট।কাজেই এখন এ
নিয়ে আন্দোলন করে লাভ নেই। এখন তাঁদের বিদ্যালাভের সময়। রাজা তো এখন ধৃতরাষ্ট্রই।
এ ব্যবস্থার কোনো বদলের দাবী তিনি করতে তিনি আসেন নি। বরং এই বংশের বাকী পাঁচটি
ছেলেকেও শিক্ষার সমান সুযোগ দেবার অনুরোধটুকুই জানাচ্ছেন তিনি।
কুন্তীর এই চমৎকার বুদ্ধিতে সব গোলযোগ
থেমে গেল। ফুটফুটে পাঁচটি শিশু এরই মধ্যে তাদের বিনম্র উপস্থিতিতে কুরুবংশের
গুরুজনদের মন জয় করে নিয়েছিল। কাজেই তাদের গ্রহণে আর কোন বাধা রইলো না। কুন্তী
প্রাসাদের অংশও দাবী করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় দেবর বিদুরের গৃহে আশ্রয় নিলেন।
এইভাবে তিনি শুধু তাঁর নির্লোভ ব্যক্তিত্বই প্রমাণ করলেন না; সন্তানদের নিরাপত্তাও
সুনিশ্চিত করলেন। রাজনীতিতে গুপ্তঘাতকের অভাব তো কোনকালেই ছিল না! তিনি জানেন তাঁর
দেবাংশী পুত্রেরা বিদ্যায়, পরাক্রমে ও বুদ্ধিতে সবাইকে ছাড়িয়ে উঠবেই। আর সিংহাসন
লাভের জন্য সেটাই হবে তুরুপের তাস। আর এই কাজের জন্য প্রয়োজন জ্যেষ্ঠভ্রাতা
যুধিষ্ঠিরের উপর বাকি চার ভাইয়ের অসীম আনুগত্য। তা এই বোধ তিনি ছোট থেকেই তাদের
মধ্যে দৃঢ়প্রোথিত করেছেন। তাঁর জীবনের এখন একটাই লক্ষ্য – সন্তানদের তাদের পিতার
সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া।
হস্তিনাপুরের
রাজপ্রাসাদে ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে একশোপাঁচটি বালক। নিজেদের খেলা, দুষ্টুমির
সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্র এবং শস্ত্রবিদ্যায় পারঙ্গম হয়ে উঠতে থাকে তারা। আর কুন্তীর
আশা সত্যি করে মেধা ও স্বভাবগুণে পঞ্চপাণ্ডব কুরুকুলের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে।
গুরু দ্রোণ তো অর্জুনকে চোখে হারান। পৃথিবীর সেরা ধনুর্ধর হিসেবে তাকে তৈরি করার
শপথ তাঁর। এভাবেই একসময় শিক্ষাকাল শেষ হয়। আজ তাদের অধীত শিক্ষা প্রদর্শনের দিন।
প্রত্যেকে একে একে
তাঁর নৈপুণ্য দেখাল। প্রত্যাশামতোই
সেরা প্রদর্শন অর্জুনের। তৃপ্ত দ্রোণ প্রিয় শিষ্যকে সেরা ধনুর্ধরের শিরোপা দিতে
যাবেন, এমন সময় বাধা এল এক জ্যোতির্ময় কিশোরের কাছ থেকে। সে এতক্ষণ বসে বসে দেখছিল
অর্জুনের নৈপুণ্য। তার নাম কর্ণ। এবার সে উঠে দাঁড়াল। একে একে অর্জুনের করে যাওয়া
সকল কৌশলের পুনরাবৃত্তি করে সদর্পে ঘুরে দাঁড়াল দ্রোণের দিকে। এবার কাকে
শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেবেন গুরু দ্রোণ?
সবচেয়ে বড় চমকটা পেলেন
কুন্তী! একে তো তীরন্দাজ অর্জুনকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে এই ভাবনাটাই তাঁকে অবাক
করেছিল প্রথমটায়। তারপর স্পর্ধিত যুবককে ভালো করে দেখে মাথা ঘুরে গেল তাঁর। এ কাকে
দেখলেন তিনি? ওই দিব্য কবচ-কুণ্ডল যে বড় চেনা তাঁর। ভালো করে দেখলে সেদিনের সেই
সদ্যোজাত কচি মুখখানির আভাসও কি নেই এই তরুণ দৃপ্ত মুখে? পায়ের তলার মাটি কেঁপে
উঠল তাঁর। এই তাঁর প্রথম পুত্র? তাঁর কলঙ্কের সাক্ষী অথচ প্রথম স্নেহের ভাগীদার আজ
তাঁর স্বীকৃত পুত্রের প্রতিপক্ষ! কিন্তু কী
বলছে সেই ছেলে? সে সূতপুত্র? অধিরথ সারথির সন্তান? সে রাধেয়?
মায়ের এই যন্ত্রণা,
দোলাচলের মধ্যেই দ্রুতলয়ে ঘটে গেল পরপর কয়েকটি ঘটনা। ইতিমধ্যে কর্ণ অর্জুনকে
দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছে এবং সেই আহ্বানের পথ সুগম করতে দুর্যোধন কর্ণের
অঙ্গরাজ্যে অভিষেক করিয়েছে। অসহায় কুন্তী বসে বসে দেখলেন জ্যেষ্ঠ পুত্রের সম্মান ও
আদর এবং একই সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করলেন তাঁর দুই মহারথী পুত্রের মধ্যে একটি অপার
বিরোধের প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেল। আর কতো নিতে পারেন পৃথা – তিনি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে
পড়লেন। আর তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরায় তখনকার মতো গণ্ডোগোল থেমে গেল।
পরে সুস্থ হয়ে মাথা
ঠাণ্ডা হলে কুন্তী ভাবে দেখলেন, যা হয়েছে তা এখন তাঁর আয়ত্ত্বের বাইরে। একটি
স্বীকৃতি তাঁকে হয়ত তাঁর প্রথম নাড়িছেঁড়া ধনকে ফিরিয়ে দেবে; কিন্তু এতে রাজমাতা
এবং রাজবধু কুন্তী শুধু নিজেই কলঙ্কভাগী হবেন না
একই সঙ্গে আনিশ্চিত করে তুলবেন বাকি সন্তানদের জীবনও। অতএব তিনি মনে মনে
কর্ণকে আরও একবার বিসর্জন দিলেন। আঁকড়ে ধরলেন তাঁর পাঁচ পুত্রের ভবিষ্যৎ আর নিজের
সুনামকে।
এর জন্যই কুন্তী আমাদের
কাছে এক অমীমাংসিত প্রহেলিকা হয়ে থেকে যান। তিনি এমন একজন মা – যিনি নিজের এবং
সপত্নীপুত্রদের মধ্যে কোনদিন কোন বিভাজন করেন নি। বরং মাদ্রীপুত্র সহদেব তাঁর
সবচেয়ে আদরের ধন। তবু সেই
স্নেহময়ী জননী তাঁর প্রথম পুত্রকে দ্বিতীয়বারও বিসর্জন দিলেন কী উদাসীন
নৈর্ব্যক্তিকতায়! অথচ পিতা দায়িত্ব নিলে কানীন পুত্র তখন সমাজে স্বীকৃত ছিল। স্বয়ং
মহর্ষি বেদব্যাস তার প্রমাণ। অথচ কর্ণকে তার পিতা মাতা দুজনেই ত্যাগ করেছিলেন।
কেউই তার দায়িত্ব নেন নি!
পাণ্ডবদের ক্রমবর্ধমান
জনপ্রিয়তা ও পরাক্রম দুর্যোধনকে ক্রমশঃ অসুখী করে তুলছিল। তাঁরা এখন আর ছোট নেই।
অনেকদিন পর্যন্ত দুর্যোধন জানতেন হস্তিনাপুরের ভাবী রাজা তিনি। হঠাৎ করে পাণ্ডবদের
আগমন তাঁর কোনদিনই মনঃপুত হয় নি। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বৈরিতা বেড়েছে বই
কমেনি। অতএব শকুনির সঙ্গে পরামর্শ করে দুর্যোধন পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোর
ব্যবস্থা করলেন। সেখানে জতুগৃহে তাঁদের পুড়িয়ে মারাই তাঁর উদ্দেশ্য। বিদুরের
বুদ্ধিতে পাণ্ডবেরা সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন বটে; কিন্তু তার আগে? পালাবার আগের
দিন সেই যে এক দরিদ্র নিষাদরমণী তার পাঁচটি ছেলে নিয়ে তাঁদের আশ্রয় নেয়? তাদের
খাইয়ে দাইয়ে ঘুমের ব্যবস্থা করে ঘরে আগুন লাগিয়ে পালানোর বুদ্ধিটি? তাতে কুন্তীরও
তো সায় ছিল! যাতে সকালে ছয়টি অগ্নিদগ্ধ দেহ দেখে দুর্যোধন তাঁদের মৃত্যু সম্বন্ধে
নিশ্চিত হন, আর কুন্তী তাঁর সন্তানসহ নিরাপদে অজ্ঞাতবাসে থেকে সুসময়ের অপেক্ষা
করতে পারেন।
কুন্তী চরিত্রের
জটিলতা ও বৈপরীত্য আমাদের পদে পদে বিস্মিত করে। একদিকে উদার, স্নেহময়ী জননী, আবার
অন্যদিকে এক অসম্ভব নির্মম এক রাজনীতিক। যিনি ঠাণ্ডামাথায় সন্তানসহ এক রমণীকে
পুড়িয়ে মারতে পারেন, সেই তিনিই আবার বনবাস
কালে আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণকে রক্ষা করার জন্য অপত্য ভীমকে বকরাক্ষসের কাছে পাঠাতে
দ্বিধাহীন! ভীমের জন্য যুধিষ্ঠিরের আশঙ্কাকেও তিনি বিন্দুমাত্র আমল দেন না। এটা কী
কুন্তীর প্রবল জাত্যাভিমানেরও পরিচয় বহন করে? অন্ত্যজ রমণী তাঁর কাছে হয়তো মানুষের
আসনেই বসার যোগ্য নয় – এমনটাও হতে পারে। আবার যখন তাঁর মনে হয় দ্রৌপদীর মতো
বহ্নিশিখা থেকে দূরে থাকা কোন পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, বরং এ নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ের
মধ্যে বিবাদ বা অসন্তোষের বীজ জন্মাতে পারে – তখন তিনি নারী হয়েও তাঁর একটি সাধারণভাবে
উচ্চারিত কথাকেই সত্য করে তোলেন। কিংবা হয়তো যাঁকে বার বার ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্ম
দিতে হয়েছে, এ ব্যবস্থার অস্বাভিকতা তাঁর নজরে পড়েনি। ফলে দ্রৌপদীর পঞ্চপতির সংসার
হয়!
এরপর অল্প কিছুদিনের
জন্য কুন্তীর সুখের সময়। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভ, রাজচক্রবর্তী হয়ে ওঠা, সব কিছুই
সুন্দর চলছিল। কিন্তু জুয়াসক্ত রাজা কবেই
বা তাঁর রাজ্য ধরে রাখতে পেরেছেন? ফলে পাশাখেলায় রাজ্য, ধন, পত্নীর সম্মান সব
হারিয়ে তিনি সপরিবারে বনবাসী হলেন। কুন্তী একাকিনী রয়ে গেলেন বিদুরের কাছে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের
ঠিক আগে কুন্তীকে আবার আমরা দেখি সম্পূর্ণ অন্য রূপে। সে সময় যুধিষ্ঠির যে কোন
মূল্যে শান্তির প্রার্থী – পঞ্চগ্রামের পরিবর্তে রাজ্যের দাবী ছেড়ে দিতে রাজি –
তখন কুন্তী গর্জে ওঠেন। না, সন্তানদের রাজ্যকামনায় নয়। কুরুসভায় দ্রৌপদীর যে
চূড়ান্ত অপমান হয়েছিল, তার প্রতিবিধানের জন্য। রাজ্য নয়, সম্পদ নয়, এক নারী হয়ে
আরেক নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য। সেই অপমানের বদলা নেবার প্রতিশ্রুতি যে ভোলে, সে
আর যেই হোক, তাঁর সন্তান নয় – এমনধারা কঠোর বাক্যও তাঁর মুখে শোনা যায়। সেই
পুরুষশাসিত দ্বাপর যুগে দাঁড়িয়ে এই তীব্র
প্রতিবাদ আমাদের বহুক্ষণ বিস্ময়াবিষ্ট করে রাখে।
যুদ্ধ শুরু হল। এইবার
কুন্তীর মাতৃহৃদয় সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি খুব ভালো করে
জানেন, ভীষ্ম, দ্রোণের মতো মহারথীদের হাতে পাণ্ডবদের বিশেষ ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
তাঁরা প্রত্যেকেই এদের প্রতি স্নেহপ্রবণ। একমাত্র ভয়ের জায়গা তাঁরই ঔরসজাত কর্ণ!
যে হাত রক্ষাকবচ হয়ে ভাইদের রক্ষা করতে পারত, পরিস্থিতি আজ একশ’ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে
সেই হাতেই অস্ত্র তুলে দিয়েছে। নিরপেক্ষ থাকাই হয়ত তাঁর পক্ষে সঙ্গত ছিল, কিন্তু
যে প্রাণগুলিকে তিনি নিজের হাতে লালন পালন করে এত বড় করে তুলেছেন, তাদের দাবীই বড়
বেশি ভারি হয়ে দেখা দিল। এই তৃতীয় বারেও তিনি কর্ণকেই বিসর্জন দিলেন।
রোজ ভোরবেলা নদীবক্ষে
সূর্যস্তব করেন কর্ণ। উদায়ভানুর
সঙ্গে অজানা এক অদ্ভুত বাঁধনে বাঁধা তিনি। পূজাশেষ জল থেকে যখন উঠে আসেন, তখন কোন
প্রার্থীর প্রার্থনা তিনি ফেরান না। কুন্তী সেটা জানতেন। তাই ধর্মক্ষেত্র
কুরক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে কর্ণের দ্বারে আজকের প্রার্থীর নাম
কুন্তী!
কুন্তীর মুখে নিজের
জন্মকথা, সূর্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের বা কবচকুণ্ডলের রহস্য জেনে সেই যুবকের মনে
যে ঝড় উঠেছিল, তার কতটা আঁচ পেয়েছিলেন অথবা অনুধাবন করেছিলেন পৃথা, তা জানা যায়
না। হয়তো সেই অবকাশও তাঁর হাতে ছিল না। তিনি তখন কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে নিয়ে আসতে
ব্যস্ত –
রাজ্যলোভ – ‘দোলাবেন
ধবল চামর যুধিষ্ঠির’ – যদিও কুরুবংশের সিংহাসনে কর্ণের অধিকার কী করে হয়, সে
বিষয়টা স্পষ্ট নয়। হয়ত বিজেতারাই নিয়ম তৈরি করে – জাতীয় কিছু হয়ে থাকবে। তাতেও কর্ণের হেলদোল
নেই দেখে কর্ণকে দ্রৌপদীর পতি হবার লোভ দেখাতেও বাধল না পাণ্ডবজননীর! নদীতীরে এক
নারীর হাতে দ্বিতীয়বার বস্ত্রহরণ ঘটল এক অভাগিনীর। যেন তেন প্রকারেণ কর্ণকে
স্বপক্ষে আনার চেষ্টায় কুন্তী তখন অন্ধ।
এইখানে আমার একটু
সন্দেহ হয়। কুন্তীর মতো প্রখর বুদ্ধিশালিনী এবং ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞানসম্পন্ন নারী
কি সত্যিই কর্ণকে নিজপক্ষে করতে চেয়েছিলেন? অথবা যুদ্ধ থামাতে? নাকি তিনি জানতেন
যে, কর্ণের মতো এক মহাবীর ও উদারমনা পুরুষ, তাঁর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ছাড়া
অন্য কিছু করতেই পারেন না? দ্রৌপদীর উল্লেখ কি সেই প্রত্যাখ্যান নিশ্চিত করতেই? কর্ণের
প্রতি তাঁর সেই স্নেহ থাকলে তিনি তো পাণ্ডবদেরও একথা বলতে পারতেন? কিন্তু তা তো
নয়! আসলে তিনি এসেছেন কর্ণের মনোবল ভেঙে দিতে। যাদের তিনি নিজের পুত্র বলে স্বীকার
করেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
বারবার তিনবার। আর
কতবার কত ভাবে পরিত্যক্ত হবেন কর্ণ? অর্জুন বাদে
চার পাণ্ডবের প্রাণদান এবং জন্মদাত্রীর গোপনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোধহয়
জন্মঋণ শোধ করলেন রাধেয়। আর কুন্তী? এক সফল অভিযানের শেষে
ঘরে ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু এই দান গ্রহণের দীনতা তাঁর মর্মভেদ করল। নিজের
তুচ্ছতায়, সংকীর্ণতায় রোজ একটু একটু করে মরে যেতে লাগলেন পৃথা।
যুদ্ধ শেষ হল যখন, তখন
আর বোধহয় এই গ্লানি বহন করতে পারলেন না পৃথা। পুত্রদের কাছে কর্ণের পরিচয় দিয়ে তাকেও
মর্যাদার সঙ্গে দাহ করার কথা বললেন। শোকে আকুল হলেন পাঁচভাই। বিচলিত যুধিষ্ঠির
অভিশাপ দিলেন পৃথাকে – নারীজাতি এরপর থেকে সত্য গোপন করার ক্ষমতা হারাল।
চিরকাল যাকে ত্যাগ করে
এসেছেন সেই কর্ণ নন, অভিশাপ দিলেন যুধিষ্ঠির – যাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি
সবকিছু বাজি ধরেছিলেন। চূড়ান্ত আত্মগ্লানি আর নির্বেদ গ্রাস করল কুন্তীকে।
পাণ্ডবদের রাজ্যাভিষেকের কিছুদিন পরে তিনিও ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর সঙ্গে
বাণপ্রস্থে গেলেন। সেখানেই এক ভয়ঙ্কর দাবানলে তাঁদের মৃত্যু হয়। বাইরের দাবানল
পৃথার অন্তরের দাবানলকে প্রশমিত করলে কিনা জানিনা, শুধু তাঁর নশ্বর দেহ ছাই হয়ে
গেল।
কুন্তী তাঁর জীবনে
চারবার গর্ভধারণ করেছিলেন দেবতাদের আহ্বান করে। একবার স্বেচ্ছায়, বাকি তিনবার তাঁর
স্বামীর আদেশে। কিন্তু চিরজীবন তিনি ঐ একবার স্বেচ্ছাধীন হবার মূল্য চুকিয়ে গেলেন।
তাঁর ত্যাজ্যপুত্র তাঁকে বর দিল, আর যে স্বীকৃত সন্তানদের জন্য তিনি সারাজীবন
প্রাণপাত করলেন, রাজরানী, রাজমাতা হওয়া সত্ত্বেও চিরজীবন কাটালেন দারিদ্র্যকে
সঙ্গী করেই – সেখান থেকেই পেলেন অভিশাপ। এর চেয়ে বড় নিয়তির পরিহাস আর কীই বা হতে
পারত! তবু কুন্তীর এই হার না মানা চরিত্রের সামনে নতজানু হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু
করবার নেই।
1 comment:
কুন্তী এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম, খুব ভালো বিশ্লেষন করেছেন। মনে হচ্ছিল যেন মৌলিক কোন গল্প পড়ছি। কিছু জায়গা তো অসাধরন - এইখানে আমার একটু সন্দেহ হয়......তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আরো ভালো লিখুন, ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।
Post a Comment