Saturday, December 8, 2018

পঞ্চকন্যা_(২) - দ্রৌপদী


অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাতক নাশনম॥
*

পঞ্চকন্যার দ্বিতীয়জন দ্রৌপদীআক্ষরিক অর্থেই অগ্নিকন্যা। মহাভারতের সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব। এক স্বয়ংসম্পূর্ণা ক্ষত্রনারী। পঞ্চভূতের মধ্যে তেজসরূপিনী এই রমণীর দিকে তাকিয়ে আমার বিস্ময় আর শেষ হতে চায় না।

আশীর্বাণী হিসেবে সাবিত্রীসমান হও শুনেছি বহুবার। কিন্তু দ্রৌপদী হও – এ কথা বলতে শুনিনি একজনকেও! তাহলে কি, এই শ্লোকটা – যাকে বলে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, তাই? মানে স্মরণ করো, পূজন করো কিন্তু অনুসরণ? নৈব নৈব চ। মনে রেখ নারীকুল, গণ্ডীর বাইরে পা বাড়িয়েছ তো এদের মতোই অশেষ দুঃখ লেখা আছে কপালে! আমার পড়াশোনা খুব সীমিত, এ বিষয়ের প্রকৃত অধিকারী কেউ যদি এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন, তাহলে খুব কৃ্তজ্ঞ থাকব।

অনেক ভেবেছি, জানেন? সামান্য বইপত্র যেটুকু ঘেঁটেছি, তাতে এ প্রশ্নের উত্তর পাই নি। অবশ্য সবিনয়ে স্বীকার করব, মূল সংস্কৃতে কোন বই পড়ার বিদ্যে আমার নেই। অনুবাদ ভরসা। তাই আপনাদের কাছেই প্রশ্নটা রাখলাম। আর অতি সঙ্কোচের সাথে আমার যেটুকু মনে হয়েছে তাই আপনাদের সামনে তুলে ধরলামকোন ধর্মীয় চেতনা বা সংস্কারে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার নিজস্ব বিশ্লেষণটি তুলে ধরছি, শুধুমাত্র বহুদিন ধরে জমে থাকা একটি সংশয়ের সমাধানের জন্য। আর হ্যাঁ, আমার কাছে দ্রৌপদী বরেণ্য, তিনি একজন মানবী বলেই।  তাঁর সত্ত্বাকে কোন দৈবী রূপক দিতে আমি নারাজ।
·        
·        
দ্রৌপদী॥
পঞ্চনারীর দ্বিতীয়া দ্রৌপদী। অযোনিসম্ভূতা, যজ্ঞ থেকে উত্থিতা, অনন্যসুন্দরী, কৃষ্ণা এক রমণী। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ধৃষ্টদ্যুম্ন বা কৃষ্ণা কেউই দ্রুপদের ঔরসজাত নন। দ্রুপদের একমাত্র ঔরসজাত পুত্র শিখণ্ডী  ক্লীব ছিলেন। তাই তিনি বাল্যসখা দ্রোণের দর্পহরণের নিমিত্ত যজ্ঞের মাধ্যমে সন্তান চেয়েছিলেন।

 এই যজ্ঞের মাধ্যমে সন্তানলাভ বহুচর্চিত একটি বিতর্কিত বিষয়। তার মধ্যে আমি ঢুকতে চাই না। ধ্বংসের জন্য, ক্লান্ত পৃথিবীর ভারহরণের জন্যই নাকি দ্রৌপদীর জন্ম। দ্রৌপদীর কৃষ্ণবর্ণ কি সেদিকেই ইঙ্গিত করে? তিনি চেয়ে বা না চেয়েও বারংবার ক্রীড়নক হয়েছেন সেই অদৃশ্য মহাশক্তির। তবু এই নারী  সর্বযুগের সর্বকালের বিচারে অনন্যা। তীব্র তেজ, ক্ষুরধার বুদ্ধি, যুক্তিসচেতনতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত এক অসামান্যা রমণী।

তাঁর স্বকীয়তা বারবার আঘাত করেছে, প্রশ্ন করেছে, বিব্রত করেছে একান্ত পুরুষশাসিত সেই দ্বাপরযুগকে নিজের স্বয়ংবরসভায় সভার নিয়ম ভেঙে তিনি ঘোষণা করেন, সূতপুত্র কর্ণের গলায় মালা দিতে তিনি অপারক। জাত্যাভিমানে তিনি ঠিক করলেন না ভুল করলেন, সেটা বড় কথা নয়, সদ্যযৌবনা – কিশোরীও হয়ত বলা যায় আজকালকার বিচারে – তার এই প্রতিবাদের সাহস আমাকে চমকিত করে।  

তবু, এইখানে আমার একটি ব্যক্তিগত সংশয় আছে। কাশীরাম দাস বলছেন, কর্ণ ধনুক ওঠাবার আগেই ঘোষণা করেছিলেন, তিনি লক্ষ্যভেদ করলে এই কন্যা পাবেন তাঁর মিত্র দুর্যোধন। সেই দুর্যোধন, যিনি কিছু পূর্বে ধনুক তুলতে গিয়েই সপাটে আছাড় খেয়েছিলেন! বীরপণ্যা এই নারী নিজের এই ভবিষ্যৎ মানতে পারেন নি বলেই কি কর্ণকে থামাবার জন্য হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে তাৎক্ষণিক তাগিদে যা মনে এসেছিল তাই বলে কর্ণকে নিরস্ত করেছিলেন? কারণ কর্ণ সফল হলেও নিয়মানুসারে তো তাঁকে সূতপুত্রবধূ হতে হত না। কর্ণ যদি নিজের জন্য লক্ষ্যভেদ করতে চাইতেন, তাহলেও কি দ্রৌপদী এই কথাই বলতেন? কে জানে! কারণ একটু পরেই যখন দরিদ্র ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন মৎসচক্ষু বিদ্ধ করার জন্য ধনুকে শরযোজনা করবেন, তখন আজন্মসুখলালিতা রাজকন্যাটি কিশোরীর নরম লাজুক প্রেমে থরো থরো হয়ে প্রার্থনা হবে, - “হে ঈশ্বর, যেন সফল হয় এই তরুণ!”

পণে জয়ী তরুণের গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছিল সেই নারী। এরপর ক্ষত্রসমাজ নিজেদের অপারগতা ঢাকতে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গরীব “ব্রাহ্মণ’টিকে ‘শাস্তি’ দিতে। একবারও তাঁদের কেউ ভেবে দেখলেন না, একটু আগেই সভাতে বারবার জাতিনির্বিশেষে লক্ষ্যভেদে সমর্থ বীরকে আহ্বান করা হয়েছিল

সবচেয়ে অবাক কথা, পরবর্তী যুগেও কাব্যে গল্পে প্রবন্ধে প্রায়-কিশোরী দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যান নিয়ে ঝড় উঠেছে বারবার; অথচ ঐ একই সভাতে তার কিছুক্ষণ বাদেই সভার সব নিয়ম ভেঙে, পরিণতবয়স্ক রাজন্যবর্গ একযোগে যেভাবে এক ব্রাহ্মণকে আক্রমণ করলেন, সেভাবে তার কোন সমালোচনা আমার সীমিত অধ্যয়নের নজরে আসে নি।

যাই হোক, অর্জুন এবারেও জয়ী হলেন, কিন্তু কৃষ্ণা-অর্জুনের মিলন হল না! কারণ কী? না, কুন্তীর উক্তি – যা ভিক্ষা এনেছো, পাঁচজনে তা ভাগ করে নাও। যুধিষ্ঠিরের ব্যাখ্যাটিও অপরূপমায়ের মুখের বচন মিথ্যা হতে দিলে নরকেও ঠাঁই হবে না তাঁদের! সদা ন্যায়কারী ধর্মরাজ সুচতুরভাবে ভুলে গেলেন দ্রৌ[পদী ভিক্ষলব্ধ নন, অর্জুনের বীরত্বের অর্জন তিনি ততক্ষণে বুঝে গেছেন যে আগুনের মতো সুন্দরী কৃষ্ণার রূপে তাঁর মতো বাকি ভাইদেরও মাথা ঘুরে গেছে! এর মধ্যে ব্যাসদেব পুরো ব্যাপারটা আরও জটিল করে তুললেন পূর্বজন্মের গল্পকথা দিয়েআগের জন্মে দ্রৌপদী নাকি তপস্যা করে পঞ্চপতির বর পেয়েছিলেন! ব্যাসদেবের মতো ব্যক্তিত্বের মুখের ওপর কথা বলা সেই প্রায় কিশোরীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এক কুমারী হয়তো তার দেওয়া মালা গলায় পড়া – এক যুবকের দিকে বড় আশা নিয়ে তাকিয়েছিল। কিন্তু সেই পুরুষের কাছে প্রিয়ার চেয়ে পারিবারিক আনুগত্যের দাম বেশি। কিম্বা হয়তো সেই যুবকও লক্ষ্য করেছিল বাকি ভাইদের মুগ্ধ চোখ। সে যে জানত, এই দুনিয়ায় টিঁকে থাকতে হলে পাঁচ ভাইকে এক হয়ে থাকতেই হবে। এর অন্যথা নেই।

অর্জুন আপত্তি করলেন না। বরাবরের মতো তিনি এবারেও জ্যেষ্ঠভ্রাতার অনুগামী হয়েই রইলেন। তাতে তাঁর হৃদয়ে কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছিল, সে খবর কারো জানা নেই। আর দ্রৌপদীর কথা বলার মতো কলমের জোর আমার নেই। তাঁর মতামত বোধহয় কেউ চায়ও নি। কারণ তো আগেই শোনা গেছে, আগের জন্মে নাকি তিনি পাঁচজন একই রকম দেখতে দেবতাদের মধ্যে একজনকে বিশেষভাবে নির্বাচন করতে পারেন নি!প্রায় কিশোরী মেয়েটি কয়েকঘণ্টা আগেই তার মাল্যদানকে কেন্দ্র করে একটা তুমুল খণ্ডযুদ্ধ দেখে এসেছে। এখন আবার আপত্তি জানাতে গেলে যদি ভাইয়ে ভাইয়ে....। তার উপর এই অদ্ভুত বিধানকর্তা তো আর কেউ নন – স্বয়ং ব্যাসদেব! যে বিরাট বীরপুরুষটিকে বরণ করেছিলেন, তিনিই তাঁকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করবেন – এমন একটি আশাও হয়তো করেছিলেন কৃষ্ণা কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। এই সবকিছুর ফলে দ্রৌপদী পেলেন পঞ্চপতি! স্থির হল এক বছর পর পর সিনিয়রিটি অনুযায়ী পাল্টে যাবে তাঁর স্বামী পরিচয়। অর্থাৎ আজ যে স্বামী, কাল সে ভাসুর বা দেবর! আহা কৃষ্ণার মতো সুখের কপাল করে আসে কজন নারী! অতএব সেই দায় মেটাতে প্রথম বছরে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরপত্নী। আর দ্বিতীয় নিয়ম হলো, এক ভাইয়ের একান্ত অবসরের মুহূর্তে যদি উপস্থিত হন দ্বিতীয়জন, তাহলে শাস্তিস্বরূপ তাঁকে বারো বছরের বনবাসে যেতে হবে।

এই প্রথম বছরে অনেকগুলি ঘটনা ঘটবে। পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থের রাজত্ব পাবেন। বসতি গড়ার মুখে মুখেই সেই রাজ্যে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের গরু চুরি হবে। গরু উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে নতুন রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তদুপরি ব্রহ্মশাপের ভয় তো আছেই। অতএব অর্জুন দৌড়োলেন অস্ত্র আনতে। অথচ সেই মুহূর্তে অস্ত্রাগারে যুধিষ্ঠির তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্রাম্ভালাপে ব্যস্ত। রাজমহলে এত জায়গা থাকতে যুধিষ্ঠিরের মতো নির্বোরোধী মানুষের এই ঘরটিই কেন পছন্দ হল জানা নেই, কিন্তু অর্জুন দ্বিধা করলেন না। তাঁর মতো বীরের যা কর্তব্য তিনি তাই করলেন। তিনি খবর দিয়ে অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলেন। ব্রহ্মশাপ থেকে রাজ্যকে বাঁচালেনতারপর বারো বছরের জন্য বনবাসে চলে গেলেন! যুধিষ্ঠির অতি দুর্বলভাষে ভাইকে বাধা দিলেন বটে, কিন্তু স্বাভিমানী অর্জুন যে সে কথা শুনবেন না, সেও তো তাঁর জানার কথাই

দ্রৌপদীর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। তাঁর একান্ত মুহূর্ত – যাতে অধিকার ছিল একমাত্র অর্জুনের, সেইখানে তাঁর প্রাণের পুরুষটি এলেন দেবরের বেশে! কিন্তু ততদিনে মাতা কুন্তীর কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। আজ তিনি জানেন পঞ্চপাণ্ডব যতদিন একসঙ্গে থাকবেন, ততদিনই তাঁরা অপরাজেয়। যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধ, ভীমের শক্তি, অর্জুনের বীরত্ব, নকুল সহদেবের জীব সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও দূরদর্শিতা সব এক খুঁটিতে বাঁধা থাকতেই হবে। নিজের সমস্ত ব্যক্তিগত বেদনা ও চাহিদার ওপরে উঠে তাঁকে পাঁচ স্বামীকে একসূত্রে গ্রথিত করতে হবে। জীবনভর তিনি সেই কর্তব্য পালন করে গেছেন। কাজেই অর্জুনের নির্বাসনে তিনি কতটা আঘাত পেয়েছিলেন, তার খবর পাণ্ডব ভাইয়েরা ছেড়ে ব্যাসদেবও জানতে পারেননি।  

এই পাঁচজনেরই আলাদা পত্নী ছিল, কিন্তু কোন অসাধারণ চরিত্রবলে তিনি অনায়াসে প্রধানা মহিষী এবং পাঁচ ভাইয়ের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন সে ভেবে আমার বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা থাকে না। নিজের দৈহিক মানসিক সব বেদনা যন্ত্রণার চেয়ে এ দায়িত্বের প্রতি তিনি বেশি যত্নশীল ছিলেন। এইখানেই দ্রৌপদী সবার চেয়ে আলাদা। সবার চেয়ে অনেক উঁচুতে।

নির্বাসনের বারো বছর পরে অর্জুন ফিরলেন যখন, তখন তাঁর অনেকগুলি বউউলূপী, চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা --। এর মধ্যে একমাত্র সুভদ্রাই এসেছেন স্বামীর সাথে ইন্দ্রপ্রস্থে। অভিমান হলেও বুদ্ধিমতী দ্রৌপদী জানতেন এটাই অবধারিত ছিল। যে অসম্ভব আত্মমর্যাদার সাথে তিনি পরিস্থিতির সামাল দিলেন, তা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। সুভদ্রাকে ছোটবোনের সম্মান দিয়ে নিজের অবস্থান আর সুভদ্রার মর্যাদা দুইই রক্ষা করলেন।

এরপর তিনি অর্জুনের স্বল্পকালীন সঙ্গ পান। কিন্তু এইসময়েই আবার যুধিষ্ঠিরের বাসনা হল রাজসূয় যজ্ঞ করার। চার ভাইকে চারি দিক জয় করতে পাঠিয়ে দিলেন। নিজে থাকলেন প্রধানা মহিষী দ্রৌপদীর সাথে রাজ্যের সুরক্ষায়। রাজসূয় যজ্ঞ হল। আসমুদ্র হিমাচলে পাণ্ডবদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হলকিন্তু পত্নীর সমস্ত নিষেধ, ভাইদের অনুনয় সব উপেক্ষা করে সম্রাট যুধিষ্ঠির পাশাখেলার বাজিতে সর্বস্ব হেরে বসলেন। তাও একবার নয়, দু- দুবার।

 প্রথমবার তো রাজ্যসম্পদ, চার ভাই, স্বয়ং এবং পত্নীকেও হেরে বসলেন! তারপর কৌররবসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার কথা আমরা সবাই জানি। কুরুসভায় লাঞ্ছিতা রাজেন্দ্রানী বারংবার আকুল হয়ে জানতে চাইলেন এক কূটপ্রশ্নের উত্তর – “মহারাজ যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে পণ রেখেছিলেন, নাকি আগে স্ত্রীকে?” পুরো রাজসভা – মনে রাখতে হবে সেখানে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর সক্কলে উপস্থিত – সবাই চুপ। চিরসত্যবাদী যুধিষ্ঠির, এমন কি যে মহাবীরের গলায় তিনি মালা দিয়েছিলেন, সেই অর্জুনও নীরব। পার্থ এবারেও অগ্রজকেই অগ্রাধিকার দিয়ে শুধু নিজেই মাথা নত করে বসে রইলেন না, ভীমকেও চেপে বসিয়ে রাখলেন। তখন, সেই কৌরবসভায় উপস্থিত একমাত্র পুরুষ – দুর্যোধনভ্রাতা বিকর্ণ ঘোষণা করলেন, - “যুধিষ্ঠির নিজে পরাজিত হবার পরে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন। তাই এই পণ অসিদ্ধ।“ তা বিকর্ণের তো আর সেই সভায় বক্তব্য রাখার অধিকার ছিল না, তাই সে কথা কেউ গ্রাহ্য করলেন না। সভামধ্যে দ্রৌপদীর চূড়ান্ত লাঞ্ছনা হল। সখা কৃষ্ণ না থাকলে সেদিন সভায় চরম লজ্জা থেকে দ্রৌপদীকে বাঁচাবার কেউ ছিল না। কুরুসভার সব বিজ্ঞ মহান ব্যক্তিরা দ্রৌপদীর দেবাংশী স্বামীরা সবাই নির্বাক দর্শক। কে বলতে পারে, তাঁরাও হয়তো মনে মনে অপেক্ষা করছিলেন জগতের বিস্ময় এই নারীকে আর একটু ভালোভাবে দেখবার জন্য? নাহলে দুর্যোধনের কাছে না হয় অন্নদায় ছিল। সূতপুত্র কর্ণের কাছে তো নয়? কই তার অসভ্য অশ্লীল মন্তব্যেরও তো প্রতিবাদ করলেন না কেউ? অবশ্য ধিক্কার দেবার কিছু নেই। কারণ আজও আমরা সেই দর্শকভাবের মহান ট্র্যাডিশন বহন করছি।

তাণ্ডব যখন শেষ হয়ে গেল, কৃষ্ণা রক্ষা পেলেন – তখন আর ভীমের সহ্য হল না। দুর্যোধন এবং দুঃশাসনের বিনাশের ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করে বসলেন তিনি। এই ভীম পরে দ্রৌপদীর অনুরোধ রাখতে নিয়ে আসবেন স্বর্গের পারিজাত, স্ত্রীর অবমাননাকারী কীচককে হত্যা করবেন, করবেন দুঃশাসনের রক্তপান কিংবা দুর্যোধনের উরুভঙ্গ।

 ধৃতরাষ্ট্রের ভয়, চক্ষুলজ্জা অথবা বিবেকবোধ পাণ্ডবদের রক্ষা করল। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে দ্রৌপদীকে বর দিতে চাইলেন। প্রথম বরে দ্রৌপদী – জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের মুক্তি চাইলেন। কি নির্মম ন্যায়বোধ! দ্বিতীয় বরে বাকি চার ভাই। ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত প্রীত হযে তৃতীয় বর প্রার্থনা করতে বললে তিনি। দ্রৌপদী জানালেন, ব্রাহ্মণের এক বর, ক্ষত্রিয়ের দুই, এবং বৈশ্যের তিন বরের অধিকার। তিনি ক্ষত্রনারী, সুতরাং.......
পুরাণকার দ্রৌপদীর ক্ষাত্র অহংকার দেখলেন। আমি দেখি এক অভিমানী অথচ তীব্র আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এক নারীকে। আমার যেন মনে হয় তিনি বলতে চাইলেন – এমন স্বামীদের ঘর করা আর দাসীবৃত্তি একই ব্যাপার। সেদিনের সভায় কৌরব আর পাণ্ডবদের আচরণে খুব কি কিছু তফাত ছিল?  ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য উপযাচক হয়ে পাণ্ডবদের দ্রৌপদী এবং রাজ্য সম্পদ – দুইই ফিরিয়ে দিলেন।

কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। দুর্যোধন আবারও যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলায় আহ্বান করলেন। নির্লজ্জ জুয়াড়ীর অহংকার নিয়ে ,আর কিছুটা তখনকার প্রচলিত নিয়মকানুনের জন্যেও যুধিষ্ঠির আবার সেই খেলার আহ্বান স্বীকার করলেন। এবারের পণ সব ধনসম্পদ. পরাজিতের বারো বছর বনবাস এবং এক বছরের অজ্ঞাতবাস। আর ঐ লুকিয়ে থাকার সময় যদি জয়ীর দলের কেউ তাদের খুঁজে পায় তাহলে তেরো বছরের রিপীট টেলিকাস্ট। যথারীতি যুধিষ্ঠির আবার হারলেন।

দ্রৌপদী পাণ্ডবদের সঙ্গে বনে গেলেন। আগেই বলেছি, পাঁচভাইয়ের প্রত্যেকেরই অন্য স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেককেই পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দেওয়া হল। মাতা কুন্তী থাকলেন বিদুরের আশ্রয়ে। কিন্তু দ্রৌপদী এতটাই তাঁদের অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যে তাঁকে আলাদা করার কথা কারো মনেও এলো না।

তবু দ্রৌপদীর জীবনে প্রথম প্রেম পার্থ, আর হয়তো বা শেষতমও। চিরজীবন যাকে চেয়ে এসেছেন, তাঁকে কতটুকু পেলেন পাঞ্চালী? বনবাসের সময়েও তো অর্জুনকে যেতে হবে হিমালয়ে তপস্যা করে দৈবী অস্ত্রের সাধনে। আর এই দীর্ঘ বনবাসে বিভিন্ন সময়ে দ্রৌপদীর কাছে ক্ষত্রিয়ের অনুপযোগী দৌর্বল্যের জন্য বারংবার তিরস্কৃত হবেন যুধিষ্ঠির। তাঁর জুয়াসক্তি, তাঁর প্রতিবাদ-অনীহা থেকে তাঁকে মুক্ত করে, এক শক্তিমান রাজপুরুষ বানাবার প্রচেষ্টায় নিরত থাকবেন পাঞ্চালী। পরাজয় স্বীকার করে ভাগ্যের কাছে নত হতে শেখেন নি যে এই রাজেন্দ্রাণী

কিন্তু এই যে জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ভাগ দিতে পারলেন না এই রমণী, তার জন্য নিয়তি তাঁকে ক্ষমা করে নি। এত কিছুর পরেও তাঁকে সইতে হল ভগ্নীপতি জয়দ্রথের হাতের লাঞ্ছনা, যুদ্ধে বীরগতি পেলেন তাঁর পিতা, ভ্রাতা, পুত্র পরিজন। তাতেও শেষ হল না। এরপরেও ঘটলো পঞ্চপুত্রের অসহায় মৃত্যু এবং সবশেষে স্বর্গারোহণের পথে তাঁর পতন! এবং এই পতনের কারণ কি বললেন যুধিষ্ঠির? পাঁচজনের মধ্যে অর্জুনের প্রতি নাকি বেশি আসক্তা ছিলেন দ্রৌপদী!

একমাত্র ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরই সশরীরে পৌঁছে যান স্বর্গে। এক এক করে পতিত হন বাকী ভাইয়েরা। আরে না, না, আশ্রিত পাঁচ সন্তানসহ নিষাদজননীকে জতুগৃহে পুড়িয়ে মারা, পত্নীর সম্মান রক্ষায় অসমর্থতা অথবা আপাত যুদ্ধশেষে সন্তানদের অরক্ষিত রেখে দূর নদীতীরে বিশ্রাম (পিকনিক?) নেবার মতো তুচ্ছ কারণে নয়, তাঁদের যেসব ত্রুটিতে পরিবারের জ্যেষ্ঠভ্রাতাটি স্বার্থ বা অহং বিঘ্নিত হয়েছে, সেইসব অপরাধে মানে, ভীম কেন এত পেটুক ছিলেন, অর্জুন কেন একদিনে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে যুদ্ধ শেষ করেন নি, নকুল কেন নিজেকে রূপবান ভাবতেন, সহদেব কেন আগে থেকে গণনা করে তাঁকে ভবিষ্যত বলে দেন নি  - এইসব গুরুতর কারণে চার পাণ্ডবের পতন ঘটে। এমনকি কৃষ্ণার প্রতি ভীমের একমুখী প্রেম, বা হিড়িম্বার চেয়ে পাঞ্চালীকে বহুগুণ বেশী ভালোবাসা ভীমের পাপ নয়, সে পাপ একান্ত দ্রুপদনন্দিনীর! ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দাম তাঁকে যে এ জন্মেই চুকিয়ে দিয়ে যেতে হবে।