Friday, November 13, 2020

ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ

 

শুভ দীপাবলী বন্ধুরা। তোমাদের/ আপনাদের জন্য একটা গল্প রইলো। ভালো থাকবেন সকলে। আনন্দে থাকবেন।

 

ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ

||দোলা সেন||

 

দাওয়ায় বসে হারিকেনের আলোয় রানী খাতায় আঁক কষছিল উলটোদিকে হিরু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আকবরের প্রবর্তিত জিজিয়া করের তাৎপর্য পড়ে যাচ্ছিল। পাশ দিয়ে যাবার সময় বড়দা গলা খাঁকারি দিতে থতমত খেয়ে খুব সময়ে নিজেকে সামলে নিল। ভাগ্যিস মা এর মধ্যে এদিকে আসে নি! তাহলে তো...

 

কিন্তু দিদির ব্যাপারটা কি? অন্যদিন তো পান থেকে চুণ খসলেই পাড়া মাথায় করে। আর আজ? মনোযোগের বাড়বাড়িটায় হিরুর মনে সন্দেহ জাগে। সে বাথরুমে যাবার বাহানায় উঠে গিয়ে ফিরতি সময়ে দিদির পিঠের পিছন দিয়ে টুকুস করে উঁকি দিল। দিদি খুব মন দিয়ে অঙ্ক খাতায় দুগ্গা ঠাকুরের মুখ আঁকছে!

 

তাই বলো! ঠিক, ঠিক। আজ হিরু শোধ তুলবে। সে ঘুরে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলো।

 

হিরুদের বাড়িটা বেশ বড়ো। কিন্তু বহুদিন রঙ না হওয়ায় দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় ছোপ ধরেছে। হিরু শুনেছে, এবার পুজোর আগে বড় তরফ নিজেদের বাড়ির রং ফেরানোর সময় এ বাড়িটার বাইরের দেওয়ালেও একটু চুণের কলি দেবে। পুজোয় এবার ওদের অনেক আত্মীয় বন্ধু আসবে, তাদের সামনে ছোটতরফের এই দৈন্যদশা একটা অস্বস্তির কারণ যাতে না হয়, তাই এই ব্যবস্থা।

 

ভবানীগড়ের জমিদারদের এককালে বেশ রমরমা ছিল। দুর্গাপুজোর শুরুটাও সেই সময়কার। তারপর কালের নিয়মে জমিদারি, একান্নবর্তী পরিবার সবই একে একে অজয়ের জলে ভেসে গিয়েছে। শুধু দুর্গাপুজোটাই এখনো টিঁকে আছে। টিঁকে আছে অবশ্য বড়তরফের সৌজন্যেই। বড়ো তরফের অবস্থা বেশ ভালো। ছোট তরফের অবস্থা পড়তির দিকে। তবে অবস্থার তারতম্য হলেও দুই পরিবারের সদ্ভাবটা এখনও বজায় আছে। হিরুর বাবা অবশ্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে, তার দিকের রঙের খরচের যতটা সম্ভব যোগাড় করতে। আজকাল বাবা শনিবার হলেই কলকাতা চলে যায়এখানকার ব্যবসায়ীদের লিস্ট অনুযায়ী জিনিস যোগাড় করে, এত বড়ো বড়ো ঝোলা নিয়ে রবিবার ফেরেবাবার সঙ্গে বড়দাও যায়। মা যতটা পারে শুকনো খাবার সঙ্গে দিয়ে দেয়। এখানকার ব্যবসায়ীরা পুজোর আগে এরকম সৎ সাপ্লায়ার পেয়ে খুব খুশি। নিরহঙ্কার নির্লোভ দীপ্তনারায়ণ চিরকালই তাদের খুব কাছের মানুষ।

 

হিরু রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিল। দিদির আঁকা নিয়ে কি কি বলবে, মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিল। এমন সময়ে ভাতের মাড়ের সুগন্ধের সঙ্গে, মাধবীলতার সুবাস মিলে গিয়ে তাকে একটু আনমনা করে দিল। মাধবী ফুটে গেছে? সে একলাফে আবার উঠোনে নেমে পড়ল। তার পোঁতা শিউলির চারাটা একটু বড় হয়েছে। চাঁদের আলোয় একটু খুঁজতেই যা চাইছিল, পেয়ে গেল। ছোট্ট ছোট্ট দুটো সাদা ফুল! নিজের গাছের প্রথম ফুল দেখার আনন্দে সে দিদির নামে নালিশ করার কথা ভুলে গেল।

 

-       সন্ধ্যেরাতে ভূতের মতো উঠোনে নাচ জুড়েছিস কেন?

এই রে! মা কখন রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে? সে  একদম টের পায়নি। একছুটে মাকে জড়িয়ে ধরে শাড়িতে মুখ গুঁজল।

-       মা, মা, আমার শিউলি গাছে ফুল এসেছে। পুজোর আর কতো দেরি?

-       এই তো দশদিন পর মহালয়া। তার পরেই তো.....

কিন্তু তুই পড়াশোনা ছেড়ে, এখন এখানে কেন?

-       ও মা, একটু দেখে আসি? ঠাকুর আর কতোটা গড়া হলো?

-       এই তো বিকেলেই দেখে এলি। এর মধ্যে আর বেশি কি হবে? কিন্তু এখন থেকেই এভাবে পড়াশোনা ডকে তুললে চলবে কি করে? যাও, পড়তে বসো গেখাবার আগে আর উঠতে যেন না দেখি।

 

মথা নিচু করে চলে যায় হিরু। আকবর কোন কোন রাজ্য জয় করেছিল, তার হিসেব মেলাতেই যায় বোধহয়।

 

তা আকবরের হিসেব মিলুক আর না মিলুক, মাধবী, টগর, পদ্মের দল সব হিসেব মিলিয়ে ফুটতে থাকল। পুজোর দালানে সিংহের কেশর, ময়ূরের পেখম, শাড়ির চুমকিরা টুক টুক করে যে যার জায়গায় লেগে যেতে থাকল। যে অসুরটাকে প্রথমদিকে নিরীহ মনে হচ্ছিল, সে এখন লাল চোখ আর তেল চকচকে হাতে বেশ ভয় জাগানো চেহারা নিয়েছে। হিরু, রানীদের অনেকটা সময় ঠাকুরদালানেই কাটে। রানীর আঁকার হাত ভালো বলে কুমোরদাদু তাকে হাঁসের পা, গণেশের ইঁদুর রঙ করতে দেয়। মহালয়ার আগের দিন অমৃতনারায়ণ এসে হাজির হলেন। প্রতি বছরের মতো এবারও দুই তরফ একসাথে অজয় নদীর ঘাটে পিতৃতর্পণ করবেন। অমৃতনারায়ণের বাড়ির অর সবাই চতুর্থীর দিন আসবে। কাজেই তার আগের কদিন তিনি দীপ্তদের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করবেন। বছরের এই সময়টায় তাঁদের হাঁড়ি আলাদা হয় না। বস্তুতঃ পুজোর কাজ, ভোগের দায়িত্বটা হিরুর মা আর বাবাই সামলে দেন। রানীও অবশ্য মার হাতে হাতে অনেক কাজ করে।

 

চতুর্থীর দিন দুপুরের মধ্যেই সবাই হই হই করে এসে পড়ল। নীলিমা একগাল হেসে অভ্যর্থনা করলেন – এসো দিদি এসো। এতোদিনে পুজো পুজো মনে হচ্ছে!সবাই ভালো আছ তো?

ভারি শাড়িটা সামলাতে সামলাতে শুভশ্রীও হেসেই জবাব দিলেন – তোমরা আছ বলেই গো। তোমার আর ঠাকুরপোর ভরসাতেই তো প্রতিবছর মাকে আনতে সাহস পাই।

-       কি যে বলো না দিদি। সবাই মিলে হাতে হাতেই তো....

যাকগে, অনেকটা পথ এসেছ, আগে হাতে মুখে জল দাও ছেলেদের তো মুখ শুকিয়ে গেছে খাবার দাবার তৈরিই আছে।

-       ছেলেদের টিকি পাচ্ছ কোথায়? আমি তো তোমার সাথে কথা বলতে বলতেই দেখলাম মণি হিরুর সাথে ওইদিকে দৌড়ে চলে গেল। টিনিটা বোধহয় রানীকে খুঁজতে চলে গেছে। এখন তুমি কারোর টিকিও খুঁজে পাবে যাবে না।

-       আহা, কদিনই আর একসাথে হয়? যাক ওরা। খাবার সময় ঠিক হাজির হবে।

-       তা বটে। দাঁড়াও, আমি কাপড়টা ছেড়েই নিচে দালানে আসছি। কতোদিন বাদে দেখা হলো!

 

ওদিকে আমগাছের তলায় মণি হিরুকে একটা হেলিকপ্টার দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। কপ্টারের লেজে একটা দড়ি বাঁধা। সেই দড়িতে টান দিয়ে ছেড়ে দিলে কপ্টারটা অনেকটা উড়ে গিয়ে পড়েহিরু মণির জন্য কাঠবেড়ালি ধরে রেখেছে। তাই দেখে মণির আনন্দের সীমা নেই।

^*^*^*^*^*^*

রানী দোতলায় জেঠিমার সঙ্গে তদারকিতে লেগে পড়েছে। বিকেলের নরম রোদে বারান্দা ভেসে যাচ্ছে। শুভশ্রী ওর ঘামভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন – মেয়েটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে।  সপ্তমীর দিন অমৃতনারায়ণের এক বন্ধু তার পরিবার নিয়ে আসবে। গ্রামের পুজো দেখার খুব শখ তাদের। তারা নাকি কোনোদিন গ্রামও দেখেনি। রানী হেসেই আকুল – সে কি গো বড়মা?

-       আরে শহরে এমন লোক অনেক আছে। তারা খুব অবাক হয় জানিস? ওখানের অত জাঁকজমক ছেড়ে আমরা প্রতি বছর গ্রামে আসি বলে।

-       আমি টিভিতে শহরের পুজোর ছবি দেখেছি বড়মা। কতো আলো! আর কতো লোক!

-       টিভি দেখলি কোথায়?

-       মামাবাড়িতে কালীপুজোয় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি।

-       একবার তোদের কালীপুজোয় কলকাতায় নিয়ে যাব। তখন নিজের চোখেই দেখতে পাবি।

 

রানী দীর্ঘশ্বাসটা লুকিয়ে ফেলে। সে জানে জেঠিমার এই পুজোয় আসা, আন্তরিকতা সবটুকুই কলকাতায় ফিরে গেলে হারিয়ে যায়। এর আগেও এমন কথা হয়েছে। নিলীমা পই পই করে তাদের শিখিয়েছেন, তারা যেন কখনও এসব কথা নিয়ে জেঠু, জেঠিমাকে বিব্রত না করে। তা অবশ্য করে না রানী। সে এখন বড় হচ্ছে। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। কথাটা এড়িয়ে সে জানতে চাইল – ওনাদের কটা ঘর লাগবে বড়মা?

-       দুটো হলেই হবে।

-       তাহলে পূবের ঘর দুটোই ভালো হবে। একটা ঘর থেকে নদী দেখা যায়। ওঁদের ভালো লাগবে। ওদিকে একটা বাথরুমও আছে। কারো কোনো অসুবিধে হবে না।

-       এইজন্যই তোকে এত ভালো লাগে। সব দিকে নজর! ওরা এলে ওদের দায়িত্বটা কিন্তু তোর উপরেই থাকল রে রানীমা

 

প্রসঙ্গটা পাল্টে যেতে শুভশ্রীও একটু স্বস্তি পেলেন বই কি। এই বিশাল দালানকোঠার পাশে কলকাতায় তাঁদের সাদামাটা ছোট্ট বাড়িটা মনে পড়ল। ওখানে এদের নিয়ে গিয়ে রাখবেন কোথায়? এই বড়তরফের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার যে ছবি সবার মনে আঁকা আছে, তা থেকে বিচ্যুত হওয়া কি অতই সহজ? ক্লান্ত ম্লান একটা হাসি ফুটল তাঁর মুখে। তার চেয়ে মেয়েটা তাঁকে একটু না হয় স্বার্থপরই ভাবল! এখানে দীপ্ত এঁদের সম্পত্তি আগলে রাখেন, ভাগের পয়সা নিয়মিত পৌঁছে দেন, তাই এইসব জাঁকজমক। পয়সা দিয়ে করাতে হলে....

^*^*^*^*^*^*^*^*

ষষ্ঠীর দিন ঢাকে কাঠি পড়ল। ঠাকুরমশাই চক্ষুদান করে প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন। পুজো শুরু হয়ে গেল। সন্ধ্যেতে গ্রামের সব ছেলের হাতে কাঁসর, শাঁখ মঙ্গলারতি – সব মিলিয়ে এ যেন এক অন্য জগত। কিসের টানে প্রতি বছর আসা – তা যদি কেউ বুঝত! মুখের হাসির সঙ্গে অমৃতের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে ধুনোর ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়।

 

সপ্তমীর দিন সকালেই এসে পড়লেন অমিয় রায়, মনোনীতা ও তাঁদের ছেলে অপূর্ব। শুভশ্রী সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। রানীকে দেখিয়ে বললেন – তোমাদের দায়িত্ব এই মেয়ের হাতে দিয়েছি গো। আমি তো অনেক সময় পুজোর কাজে ব্যস্ত থাকব। তোমাদের যা দরকার একে বলো। সব ব্যবস্থা করে দেবে। বড্ড গুণী মেয়ে।

 

অমিয়  হাসলেন – তুমি তো বাচ্চা মেয়ে দেখছি। তুমি আর আমাদের কী দেখভাল করবে? বরং আমার সঙ্গে এসো। চকলেট আছে।

 

অপূর্ব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগল। মনোনীতা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন – গ্রামের ছেলেমেয়েরা অল্পবয়েসেই অনেক কাজ জানে। শহরের মতো নয়। কি যেন নাম তোমার? চলো তো, ঘরটা একটু দেখিয়ে দেবে।

 

রানী চমকে উঠল। তবে সংযম হারাল না। বলল – আমার নাম রানী। নাম মনে না থাকলেও অসুবিধে হবে না। মতিকাকা, ওনাদের সুটকেসগুলো পূবের ঘরে পৌঁছে দাও। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন। মতিকাকা এখানেই থাকবে। প্রথম দিন একটু দেখিয়ে দিক। তারপরে নিজেরাই পারবেন।

 

রানীর মতোই চলে গেল। অমিয়বাবু বিড়বিড় করলেন  - এইভাবে কেউ কথা বলে?

 মনোনীতা মুখ বেঁকিয়ে নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে গেলেন। বেশ উঁচুগলাতেই বললেন – আদিখ্যেতা!

 

রানী এসে মায়ের সঙ্গে পুজোর যোগাড়ে লেগে গেল। নিলীমা বললেন – তুই চলে এলি যে? নতুন লোক..

 

-       মতিকাকাকে বসিয়ে এসেছি। ওদের হয়ে গেলে নিয়ে আসবে।

-       কী হয়েছে?

-       কী আবার হবে? চন্দনবাটাটা দাও।

 

 দুপুরে খাওয়ার পরে বড়রা সকলেই একটু গড়িয়ে নিতে গেল। বিকেল থেকেই আবার মণ্ডপে আসতে হবে। রানীও নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল। ডাকটা শুনে থমকে দাঁড়াল।

 

-       রানী, একটু দাঁড়াও। কথা ছিল।

-       বলুন?

-       বলুন নয় বলো। আমি আপনি বলার মতো বড়ো হইনি এখনোআমার নাম অপু। নাম না ধরে ডাকতে চাইলে অপুদা বলতে পারো।

-       ডাকার দরকার হলে ডাকবো না হয়। কিন্তু কথাটা কী?

-       আমার মা একটু কেমন যেন। কথাবার্তা বিচ্ছিরি। তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না। আমি মায়ের হয়ে মাপ চাইছি।

রানী হেসে ফেলল – নিজের মার সম্বন্ধে অমন করে বলতে নেই।

-       তুমি আমার উপর রেগে নেই তো?

-       তোমার উপর রাগ করব কেন? বলো, কি বলছিলে?

-        তোমার কি এখন কোনো কাজ আছে?

-       নাহ্। কেন?

-       আমার ঘরে জানলা দিয়ে একটা নদী দেখা যায়।

-       অজয় নদী।

-       মনে হলো কাছেই। আমাকে একটু রাস্তাটা দেখিয়ে দেবে?

-       উমম্। ভেতর দিয়ে গেলে কাছে তো বটেই। কিন্তু তুমি নতুন মানুষ। পথ চিনতে পারবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি চলো।

-       তুমি যাবে? আমার খুব ভালো লাগবে তাহলে

-       সন্ধ্যের আগে ফিরতে হবে কিন্তু। আমার কাজ আছে। কাল বরং হিরু আর মণিকে সঙ্গে  দেব। অনেকক্ষণ থাকতে পারবে তাহলে।

-       অগত্যা।

-       এই সিতু, একটু আমার মাকে বলে দিস তো, অমিয়কাকুর ছেলেকে একটু নদী দেখাতে নিয়ে গেছি।

-       জ্বী দিদি।

 

এ গলি সে গলি পেরিয়ে নদীর ধারে গিয়ে অপু মুগ্ধ হয়ে গেল। এই প্রথম সে এত কাছ থেকে নদী দেখছে। তার মোহিত অবস্থা দেখে রানী হেসেই অস্থির – দূর থেকে কি নদী চেনা যায়? জল ছুঁয়ে দেখো। এসো, এই পাথরটায় বসে পা ভেজাও। উল্টে পড়ো না যেন।

 

অপুর একটু ঘোর লেগে গেল। নদীর জল ওর পা ছুঁয়ে তিরতির বয়ে চলেছে। তার মনে হচ্ছিল তার পাশেও যেন এক নদী কলকলিয়ে কথা বলে চলেছে। সে কিছু শুনছিল না। শুধু দেখছিল। নরম সাদা বালি, জলের স্রোত, রানীর কথা, হাসি.....

 

তার আঠেরো বছর তাকে কানে কানে কিছু বলছিল। অপু কোথাও একটা ভাঙন টের পাচ্ছিল। হঠাৎই ছটফটিয়ে উঠে পড়ল। আর যেন থাকতে নেই। বলল – এবার ফিরি চল। তোমার কাজ আছে বলছিলে না?

 

রানী বড়ো নদী ভালোবাসে। নদীর পারে এলে তার সব হিসেব এলোমেলো হয়ে যায়। সে  অনেক কিছু বলছিল। বেশিটাই বোধহয় অর্থহীন। অপুর সঙ্গে, অজয়ের সঙ্গে সে কলকলিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ অপুর কথায় চটকা ভাঙল। অবাক হয়ে দেখল সন্ধ্যার অনেক দেরি। তবু অপুর ফেরার অস্থিরতা দেখে একটু খারাপই লাগল তার। সকাল থেকে সে অনেক কাজ করেছে। নদীর ধারে খানিক বসবে ভেবেছিল। যাক গে। অতিথি যখন, তখন তার উপর ঝাঁঝিয়ে ওঠা চলে না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল – চল, ফিরি।

 

অপুর মনটা অকারণেই খারাপ হয়ে গেল। সে কি ভেবেছিল, এই যে রানী নাকি নদী, তাকে আরেকটু বসতে বলবে? সে যে নিজেই যেতে চেয়েছে, তা তার মনে পড়ল না। বুকের ভিতর একটা চাপা অভিমান নিয়ে সে রানীর পিছু পিছু চলল।

 

হ্যাজাকের আলো, ধুনোর ধোঁয়ায় ঠাকুরদালান একেবারে অন্যরকম। রানী একটা সাদা চুড়িদার পরেছে। সারা গায়ে নীল ফুল। লম্বা চুল জড়িয়ে নীল ওড়না। ঠাকুরমশাইকে সে হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে চামর, ধূপ, দীপ...

 

আরতি শেষে পঞ্চপ্রদীপের থালা নিয়ে তার সমানে যখন দাঁড়াল, তখনও সে বিহ্বল হয়ে এক নদী দেখে যাচ্ছে তার ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে রানী হাতে প্রদীপের তাপ নিয়ে অপুর মাথায় বুকে ছুঁইয়ে দিল। আঠেরো বছরের বুকে প্রথম অনাত্মীয় নারীস্পর্শে অপু থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। কাঁপুনিটা পনেরো বছরের মুখেও চারিয়ে গেল। সে ভারি অবাক হয়ে অপুর মুখের দিকে চাইল, তারপর দ্রুত অন্যদিকে সরে গেল। প্রায় পালিয়ে যাবার মতোই

 

ভোরবেলারও আগে অপুর জানালায় ঢিল পড়লআগের দিন অনেক রাতে ঘুম এসেছিল, তাই একটু বিরক্ত হয়েই জানলা দিয়ে নিচে তাকালো। ছোট ছেলেমেয়েদের একটা বড়ো দল। ওদের মধ্যে হিরু, মণি আর টিনিও রয়েছে।

 

-       ও অপুদা, অজয়ের তীরে সূর্য ওঠা দেখবে তো চলো আমাদের সাথে।

 

ধুত্তেরি! এইজন্য রাত থাকতে ডাকাডাকি? না বলার জন্য মুখ বাড়াতেই দেখল দলে রানীও আছে! তাড়াতাড়ি বলল – আসছি এখুনি। একটু দাঁড়াও তোমরা।

 

আর একটুও বিরক্ত লাগছে না। দু মিনিটে তৈরি হয়ে নেমে এলো। নদীর ধারে আঁধার হালকা হয়ে আসছে। আকাশ গাঢ় থেকে হালকা নীল, তারপর লালের ছোপ, তারপরেই জল, সাদা বালি, আকাশ সবাইকে নিজের রঙে রাঙিয়ে লাল টুকটুকে সুজ্জিমামা টুক করে উঠে পড়ল। অমনি চরের গাছগুলো থেকে একটা দুটো করে পাখির দল বেরিয়ে মহা কিচিরমিচির লাগিয়ে দিল। মেঘেরা লাল থেকে হালকা কমলা, তারপর গোলাপি, শেষে একদম সাদা হয়ে দেশে বিদেশে ঘুরতে চলল। অপু তাকিয়ে দেখল, ছেলেমেয়ের দল এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। রানী দুটি হাত জড়ো করে সুর্যপ্রণাম করছে। অপু ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

 

-       জানো অপুদা, প্রতিটা সকাল একদম আলাদা হয়। কোনো দুদিনের সূর্য ওঠা একরকম হয় না।

-       সকাল মানেই যে নতুন দিনের শুরু রানী। নতুন করে ভাবার সময়।

-       তুমি কি সুন্দর করে বললে অপুদা!

-       চলো, এবার বাড়ি যাই। কাউকে বলে আসা হয়নি আমার। মা বাপি এতো সকালে ওঠে না, তাই রক্ষে।

-       এই, চল্ সবাই।

ফেরার পথে অপু একটু পিছিয়ে রানীর পাশে পাশে হাঁটে।

-       একটা কথা বলবো?

-       কি?

-       আজ আমার পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেবে?

-       ধ্যেৎ।

 

সদ্য ওঠা সূর্যের ফেলে যাওয়া সবটুকু লাল মুখে মেখে তাড়াতাড়ি দলের সঙ্গে মিশে যায় রানী। আবার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অঞ্জলিও দেয়। অপুর হাতের কিছু ফুল বোধকরি ছোঁড়ার ভুলেই রানীর মাথায় পড়ে। সন্ধ্যেয় আরতি নাচের সময় অপু ধুনুচি নিয়ে দারুণ নাচে। রানীর সেদিন তালে ভুল হয়।

 

নবমীর সন্ধ্যায় বিষণ্ণতার ছোঁয়া।

-       তোমরা কালকেই চলে যাবে?

-       সন্ধ্যায়। বিসর্জনের পরে।

-       কালকের দিনটা থাকা যায় না?

-       বাবার ছুটি নেই যে।

-       আবার আসবে?

-       আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু..

-       তাহলে সেই পরের পুজোয়?

-       চেষ্টা করব তার আগে আসতে। হয়তো অমৃতকাকুর সঙ্গে কোনো প্রোগ্রাম বানিয়ে। নাহলে পুজোয় আসবই। এত সুন্দর পুজো এই প্রথম কাটালাম।

-        

আকুল হয়ে কাঙ্ক্ষিতার হাত চেপে ধরে ছেলেটা। আর মনে মনে ভাবে, ভাগ্যে এখানে কলকাতার মতো এত আলো নেই! আসলে আঠেরো বছরের আর কতটুকুই বা স্বাধীনতা? রানীও মনে মনে ভাবে এই সময়টা যদি এখানেই থেমে থাকত!

 

পরদিন সবার চোখ এড়িয়ে একটা ছোট্ট সুন্দর পুতুল রানীর হাতে গুঁজে দেয় অপু। নবমীর দুপুরে গ্রামের মেলা থেকে হাতখরচের পয়সা দিয়ে কিনেছিল। বিসর্জনের ঢাক বাজছে –

                  ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ?

                  ঠাকুর যাবে বিসর্জন।

জলের তলায় আঁকাবাঁকা দুর্গার মুখ। তীরে কোলাকুলি, প্রণাম। ফিরে এসে মিষ্টির থালি নিয়ে শুভশ্রী সবাইকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। মনোনীতার স্বর বেজে উঠল –

 

-       একটা করে মিষ্টি তুলে নিয়ে এবার যাবার যোগাড় করো। নয়তো পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।

-       আবার এসো দিদি। তোমরা আসায় খুব ভালো লাগলো। গাড়িতে একটু ফল মিষ্টি তুলিয়ে দিয়েছি। রাস্তায় খেও।

 

নীলিমার আন্তরিক নিমন্ত্রণের জবাবে মনোনীতার পালিশ করা গলায় মধু ঝরল।

 

-       আসা কি সহজ ভাই? নেহাত কর্তার খুব গ্রামের পুজো দেখার এবং দেখানোর শখ ছিল, তাই আসা। নয়তো শহরের ওই ঝলমলে পুজো ছেড়ে এই গ্রামে আসতে আমার ছেলেই তো চায়নি। তবুও তোমরা খুব যত্ন করেছ। আমার খুব মনে থাকবে। আর তোমার মেয়ে... , কি যেন নাম – ভারি কাজের হয়েছে। আমাদের কি দেখাশোনাটাই না করেছে! ওর বিয়েতে নেমন্তন্ন করো কিন্তু। আসার চেষ্টা করব খুব। আর আসতে যদি নাও পারি, একটা দারুণ গিফ্ট তোমার পাওনা রইলো গো মেয়ে!

 

প্রায় পাথর হয়ে যাওয়া ছেলেকে টেনে গাড়িতে উঠিয়ে ড্রাইভারকে বললেন – চলো এবার।

 

গাড়ি ছাড়তে মনোনীতা সিটে শরীর এলিয়ে দিলেন। ভাগ্যে অমিয় গাড়ি আনতে চলে গিয়েছিলেন! তাই সবকিছু মনের মতো করে শেষ করতে পারলেন তিনি। রানীকে এতটা আঘাত করা তাঁর ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অপুর হাবভাব তাঁর ভালো ঠেকেনি। তাঁর মত হলো,গাছ কাটতে হলে গোড়াতেই কাটা ভালো।  বাড়ি গিয়ে অপু কিছুদিন অশান্তি করবে হয়তো। তবে ভুলেও যাবে। জীবন থেকে তিনি এটাই শিখেছেন। নিশ্চিন্তে চোখ বুজলেন মনোনীতা। কলকাতায় ফিরলে সব বদলে যাবে।

 

^*^*^*^*^*^*

রানী চুপ করেই ছিল। মনোনীতা তাকেও জীবন চিনিয়ে গেলেন বোধহয়। সে এক লহমায় অনেকটা বড়ো হয়ে গেল। লক্ষ্মী পুজোর পর ঠাকুরের আবার বিসর্জন হবে যখন, তখন একটা ছোট্ট মাটির পুতুলও সেই বাজনায় অজয়ের জলে ঘুমোতে যাবে। রানী নিজের হাতে তার বিসর্জন দেবে। দেবেই।

 

টিনি এসে পিঠে হাত রাখল – তোর মন খারাপ লাগছে? ভাবিস না। আমি কলকাতায় গিয়ে অপুদার সঙ্গে কথা বলব। অপুদা আসলে কাকিমার মুখের ওপর কথা বলতে...

-       দূর, তুইও যেমন! সব কিছু সিরিয়াসলি নিস কেন? এ তো পুজোর একটা টাইমপাস মাত্র!

হেসে গড়িয়ে পড়ল রানী। তার উচ্ছ্বসিত হাসির ধাক্কায় টিনি বিভ্রান্ত বোধ করল। রানীর ওপর গাছের ছায়া পড়েছে। তাই তার চোখদুটি যে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে, তা টিনি দেখতে পেল না। ভাগ্যিস এই আড়ালটুকু ছিল! রানী হাসতে থাকল।

দোলা সেন||